ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

‘কাকতালীয়’

শায়লা জাবীন | প্রকাশিত: ১২:৪৭ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

এই যে শুনছো, একটু এদিকে আসো তো?
একটু পর মিতা আবারো বলে উঠলো, এই যে ডাকছিলাম তো...

ড্রয়িং রুম থেকে মাহবুব বলে উঠলো, হ্যাঁ বলো...

এদিকে আসতে হবে একটু...

আমি একটা জরুরি ম্যাচ দেখছি, পাঁচ মিনিট পর আসি...? তুমি আসছো না কেন এদিকে? তুমি তো জানোই আমি খেলার সময় উঠি না!

মিতা রাগে গজগজ করতে মেঝেতে বসে পড়লো, আর বলে যাচ্ছে ধ্যাৎ তারিকা ছাই, এই ব্যাটাছেলের জাতের কোথায় যে সমস্যা, নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝে না! আমি যেতে পারলে কি আর তোমাকে ডাকি? ডাকছি যেহেতু নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজন আছে। প্রায় ২৮ বছর হলো সংসারের, তুমি কি এখনো জানো না আমি নিজে না গিয়ে ডাকছি তার মানে তোমার আসার দরকার!

ব্যথায় চোখে পানি চলে এসেছে মিতার, খানিকটা অভিমানেও...লোকটা এমন কেন! ছেলে মেয়েরা কেউই কাছে থাকে না, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া থাকে, ছেলেটাও অস্ট্রেলিয়া মাস্টার্স করতে গেছে। মাহবুব মাস ছয়েক হলো রিটায়ার করেছে, তারপর থেকে যাবতীয় সবধরনের খেলা দেখা বেড়ে গেছে, এই খেলা আগে দেখতো না সেটাও এখন দেখে যেমন ফর্মুলা ওয়ান, সুইমিং, টেবিল টেনিস, বক্সিং পর্যন্ত! আগেও খেলা পাগল ছিল কিন্তু এখন আরও বেশি হয়েছে। প্রথমদিকে মিতা ভেবেছিল থাক কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাক, কিন্তু এখন দেখছে এটা মাহবুবের পুরোদস্তুর নেশা হয়ে গেছে, ভয়ঙ্কর নেশা।

আবারো গলা উঁচিয়ে মিতা বললো, তোমার পাঁচ মিনিট এখনো হয়নি?

মাহবুব উত্তর দিলো আর এক মিনিট পর আসছি, কি যে হয় তোমার মাঝে মাঝে আমারই আসতে হবে! খালি খালি খেলার মাঝে হাঙ্গামা করো...

মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে আছে, মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখলো, পা ব্যথায় টনটন করছে, বুয়াও চলে গেছে দুপুরের পর, বিকেল প্রায় চারটা বাজে এখন।

মাহবুব এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো, এত রক্ত কেন মেঝেতে? কী হয়েছে তোমার? বলনি কেন আমাকে? ইসস এতটা পা কাটলো কি করে?

মিতা বিরক্তিকর চোখে মাহবুবের দিকে তাকিয়ে আছে, এরপর বললো তোমার প্রশ্ন শেষ হয়েছে? বলার জন্যই তো অনেকক্ষণ থেকে ডাকছিলাম, খেলা শেষ না হলে তো আবার আসা যাবে না, এদিকে একটা মানুষ মরে যাক বা পঙ্গু হয়ে যাক, কি যায় আসে কার? বাড়ির বুয়া, ড্রাইভার ডাকলেও আমি দ্রুত যাই, আর আমার জন্য দুনিয়ায় কেউ নাই।

আরেহ আমি কি জানি নাকি তুমি পা কেটে ফেলছো, বলতে হবে তো। এতটা পা কাটল কি করে? দেখি ওঠো তো আগে, বলে হাত এগিয়ে দিল মাহবুব, মিতাকে উঠালো, ডাইনিং এর চেয়ারে নিয়ে বসালো, রান্নাঘর থেকে ডাইনিং পর্যন্ত মেঝেতে রক্ত...

সকালে বুয়া গ্লাস ধুতে গিয়ে একটা ক্লাস ভেঙে ফেলেছিল, ঠিক মত পরিষ্কার করেনি মনে হয় কাচের টুকরা রয়ে গিয়েছিল রান্নাঘরে , আমি তোমার আমার জন্য চা বানাতে এসেছিলাম, হুট করে পা টা কাটল... কাঁচের টুকরা তো, এত ব্যথা করছে যে নড়তে পারছি না

ওহো, আচ্ছা তুমি এখানে থাকো আমি ফার্স্ট এইড বক্সটা আনি, বেশি রক্ত পড়লে তো মনে হয় ডাক্তার ডাকতে হবে

ডাক্তার লাগবে না পায়ের মধ্যে কাঁচের টুকরোটা এখনো বিঁধে আছে, বের করে দাও, এরপর তুলো দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দুটো প্যারাসিটামল খেলেই ব্যথা কমে যাবে। এখন ব্যথা করছে ভীষণ।

মাহবুব মিতার পা ধরে ভালো করে দেখে কাচের টুকরোটা টান দিয়ে বের করল, মিতা আআ... করে উঠলো, ব্যথায় মুখ কুচকে ফেলেছে..., এরপর মিতার পুরো পা এর পাতা ডেটল দিয়ে মুছে দিয়ে তুলোর বল লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। দুটো নাপা এক গ্লাস পানি দিয়ে বলল খেয়ে নাও তারপর চলো বিছানায় দিয়ে আসি, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ব্যথা চলে যাবে ইনশাআল্লাহ। মিতা মাহবুবের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো, তার একটু হাঁটতে কষ্টই হচ্ছে ব্যথার জন্য, শোবার ঘর পর্যন্ত আসতেই সে বেশ হাপিয়ে গেলো। শোন আমি আসছি, তুমি শুয়ে থাকো। বলে মিতার গায়ে একটা পাতলা কাঁথা দিয়ে গেল মাহবুব।

মিতার হঠাৎ ২৭ বছর আগের ঘটনা মনে পড়লো, বিয়ের পরের বছর, মাহবুবের পোস্টিং তখন দিনাজপুর, মিতা অনার্স ফাইনাল দিয়েছে তখন, এরপর মাহবুবকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য সে একা দিনাজপুর যেয়ে হাজির হয়েছিল, মাহবুব তাকে দেখে এত অবাক হয়েছিল যে ওই চেহারাটা তার এখনো মনে আছে। শীতকাল ছিলো কিন্তু মিতা বুঝতে পারেনি দিনাজপুরে এত ঠান্ডা হবে, ঢাকায় তেমন কোন শীতই ছিল না। পরদিন থেকে এমন ভয়ংকর কাঁপুনি দিয়ে জ্বরে পরল মিতা যে বিছানা থেকে উঠতেই পারেনা, বেচারা মাহবুবের অফিস থেকে ছুটি পর্যন্ত নিতে হয়েছিলো, কোথাও বেড়ানো দূরে থাক বাসায়ব সে বউ এর সেবা শুশুদ্ধা করতেই কয়দিন চলে গেল মাহবুবের।

মিতা ঘুমের ঘোরে ভুল বকতো জ্বর কমে না, উল্টো সর্দি কাশি বাঁধিয়ে বসলো, মাহবুব একটুও রাগ করেনি তখন, কয়েকমাস পর নতুন বউ এর সাথে দেখা, কোন আদর সোহাগ পর্যন্ত করতে পারেনি, অবস্থা এত খারাপ হলো যে মিতার বাবা এল ঢাকা থেকে তাকে নিতে। মাহবুবের নতুন চাকরির পর বেশ কয়দিন ছুটি নেয়ায় আর তার ছুটিও ছিল না, চলে আসার সময় মিতা মাহবুবকে বলে আসলো শুধু শুধু এসে তোমাকে জ্বালিয়ে গেলাম, মত খাওয়া-দাওয়া করো, ছুটি পেলে ঢাকায় এসো। মাহবুব হেসে বললো সারা জীবন রয়ে গেছে যন্ত্রণা শোধ দেওয়ার জন্য, তুমি আগে সুস্থ হও। তবে আমি জানি আমি অসুস্থ হলে তুমি এর থেকেও বেশি করতে। এরপর সারা জীবন মাহবুব আসলেই যথেষ্ট জ্বালিয়েছে, খুবই খামখেয়ালিতে ভরা চমৎকার একটা মানুষ। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলে কম হয়ে যায়, এমন একটা মানুষ কে তার জন্য জীবনসাথী হিসেবে মনোনীত করার জন্য, মাহবুবের অনেক বায়না, যন্ত্রণা, আবদার ছিলো জীবন ভর কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না কখনো, এজন্যই হয়তো যখন তখন বন্ধু-বান্ধব, এটা সেটা রান্নার আবদার, বিনা নোটিশে এখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়া,আত্মীয়দের কূট চাল ইত্যাদি সব হজম করতে পেরেছে।

শুধু তাই নয় জীবনে সবকিছুতেই সে মাহবুবের উপর নির্ভরশীলও হয়ে পরেছে, মাহবুব কে না বলে সে কাজ করতে পারেনা, কিছুতেই শান্তি পায় না, যেখানে ঘটুক মাহবুবকে তার বলতেই হবে। মাহবুবও অবশ্য তাই, অফিসে বাইরে যাই ঘটুক সে বাড়িতে এসে রাতের খাবারের পর চা খেতে খেতে কুটকুট করে গল্প করত সেগুলো মিতার সাথে । এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে,ভয় হয় কখন ডাক আসে... কার যে আগে আসে! ইসস আল্লাহ যদি দুজনকে একসাথে তুলে নিতো, মাহবুব ছাড়া সে চলতে পারবে না,মিতা জানে মাহবুবও না, মুখে যাই বলুক।

এই নাও তোমার চা, মেঝেটা একবারে পরিষ্কার করে তারপর চা বানালাম, এজন্য একটু দেরি হলো, তোমার ব্যথা কমেছে?

মিতা বিছানায় শোয়া থেকে আধাশোয়া হয়ে উঠে বসলো, মাহবুব মিতার পিছনে একটা বালিশ দিয়ে দিলো, বললো হেলান দিয়ে বসো, এরপর বিছানার পায়ের কাছে যেয়ে বসলো।

এত দূরে যেয়ে বসলে যে, আমার পাশে বসো...

তোমার চেহারা পর্যবেক্ষণ করার জন্য দূরে এসে বসলাম, যেন বুঝতে পারি তোমার ব্যথা কতখানি...ডাক্তার ডাকবো কিনা।

ওহ কিন্তু আমার তো তোমার কাধে মাথা রেখে বসতে ইচ্ছা করছে, ব্যথা এখনো আছে ...তবে কমে যাবে।

কিছু খাবে? তো বলো এনে দেই, খেয়ে একবারে ঘুমিয়ে যাও। ঘুমালে ব্যথা কমে

না, না কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না, চা টা মজা হয়েছে, তুমি এত ভালো চা বানাও এটা জানতে আমার ২৮ বছর লাগলো।

বারে তুমি তো কিছু করতে দাও না আমাকে, আর চা বানানো তো তোমার চা বানানো দেখেই শিখেছি, আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া যে সে আমাকে এত ভালো একটা বউ জীবনসঙ্গী হিসেবে দিয়েছিল। কত মানুষের কত কিছু শুনি, তোমার ওপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে একটা জীবন আমি কি নির্বিঘ্নেই কাটিয়ে দিলাম, এমনকি এই অবসর জীবনেও খেলাধুলা নিয়ে কাটছে, তোমার ও তো অবসরের সময় কিন্তু এখনো তুমি সংসার সামলে যাচ্ছ, ছেলেমেয়েদের বড় করতে যেয়ে চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছো, ওদের পেছনে আমার খরচ বাচাতে যেয়ে টিচার না দিয়ে নিজে পড়িয়েছ, প্রতি বছরই ওরা খুবই ভালো রেজাল্ট করেছে, আমি তোমাকে সংসারে ১০০ শতাংশ খাঁটিয়েছি অথচ তোমাকে কোনোদিন কোনো বেতন দেইনি এজন্য।

ইসস, কি বলছো এসব! ওরা কি আমার বাচ্চা না? তুমি কি আমার না? এই সংসার আমার সংসার না?

মাহবুব উঠে মিতার কাছে এসে বসলো, মিতার মাথা কাঁধে রেখে বলল, না মিতা, আমি ছাড়া কিছুই তোমার একার না, বাকি সব আমাদের, বাচ্চারা আমাদের,সংসার আমাদের, শুধু আমি তোমার। আল্লাহর কাছে চাই যখন ওপারের ডাক আসবে তখন যেন আমার সাথে তোমাকেও ডাকে, তোমাকে ছাড়া আমি কোনপারেই থাকতে পারবো না, যদিও খুবই স্বার্থপরের মত আবদার, যাবে আমার সঙ্গে একসাথে পরপারে?

মিতা মাথা ঘুরিয়ে মাহবুবের দিকে তাকালো, চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে, কিছু বলতে পারল না। মাহবুবের পাঁচ আঙ্গুলের ভেতরে নিজের পাঁচ আঙ্গুল রেখে মাথা নাড়লো শুধু।

মাহবুব মৃদু হেসে মিতার কপালে চুমু দিল।

‘খুব বেশি কিছু চাইনে
শুধু আমার সমান বাঁচো,
কমবেশি নয় কিছুতেই
শুধু এভাবেই ভালোবেসো।’

বই: ণ-ত্ব বিধান ষ-ত্ব মায়া
প্রকাশ :অমর একুশে বইমেলা ২০২৪
স্টল নম্বর :৫৫৪
রকমারি. কম

এমআরএম/এএসএম