ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

ঝগড়া

শায়লা জাবীন | প্রকাশিত: ১১:১৭ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪

ক্লাস নাইন মনে হয় বা টেন এর কোনো এক সময় সম্ভবত ১৯৯৮ সাল। কোনো কারণ ছাড়াই কোচিং ক্লাসে রবিন আর অপলার এর মধ্যে একটা ঝগড়া লেগে গেলো।

ঢাকার একটা বালিকা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা আপার বাসায় সকালে ব্যাচে এ পড়তে যেতো একঝাক ছেলেমেয়ে, ক্লাসের বেশিরভাগ মেয়ে আর গুটি কয়েকটা ছেলে ও ছিলো পাশের এক বালক বিদ্যালয়ের।

অপলাকে বাইরে থেকে একটু জেদি বলে মনে হতো, সুন্দরী বলে নাকি অন্য কিছু বোঝা যেতো না! কথা বলতো না ছেলেদের সঙ্গে। ছেলেরা খালি চেয়ে চেয়ে দেখতো, কিছু বললে কি বলে বসে, তখন তো কিন্তু কিছু বলার সাহস তৈরি হয়নি অনেকেরই ..
সেই ১৯৯৮ সালের কথা...

একদিন ক্লাস ছুটির পর সবাই বের হচ্ছে, ছেলে সেদিন মোটে চারজন, মিঠু , রবিন , ফাহিম আর নাসির। মজার বিষয় হচ্ছে মনে মনে সবাই অপলাকে বেশ পছন্দ করতো, কিন্তু কেউ মুখ ফুটে কিছু বলতো না, আর রবিন ছিলো কিছুটা তার ছেড়া টাইপের, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো.... সব কিছুই লক্ষ্য করতো কিন্তু কিছু বলতো না। ফাহিম তো ভেতরে ভেতরে শেষ তবে বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না, মিঠু দু একবার সাহস করেছিল বলার, সেই সাহসের গুঁড়ে বালি, মেয়ে ফিরেও তাকায় না।

যাইহোক ছেলেরা যে যার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রবিন এর জন্য অপেক্ষা করছে তিনতলা দরজার বাইরে, রবিনের ব্যাগ গোছানো শেষ, চেয়ারে বসে উবু হয়ে জুতার ফিঁতে বাঁধতে বাঁধতে গুনগুনানির চাইতে এক-দেড় স্কেল উঁচু স্বরে কি যেন একটা গান গাইছে। কালজয়ী সেই গান, সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে...

ক্লাসে মাত্র তিনজন মেয়ে তখন, অপলা, নীনা আর সেলিনা, অপলার বান্ধবী নীনার বাবা মোটরসাইকেল চালিয়ে নীনাকে নিতে আসে, কিন্তু সেদিন দেরি হচ্ছে, সেলিনা মাত্রই বের হয়ে গেলো, বাকিরা আগেই চলে গেছে। অপলা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে অপেক্ষা করছে নীনার বাবার জন্য, উনি নীনাকে নিতে আসলেই সেও চলে যাবে। এর মধ্যেই গানের শব্দ কানে যেতেই কি হলো কে জানে, হয়তো বা কোনো কারনে অপলার মন মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিলো, সে রবিন কে হঠাৎ ঝাড়ি দিয়ে বসলো...

‘এই ছেলে... এটা কি তোমার বাসা পেয়েছো...?! গান গাচ্ছো কেন?! গান বন্ধ করো, বাসায় যেয়ে গান গাও বা বাইরে যেয়ে, ক্লাসে না।’

ঘটনার আকষ্মিকতায় রবিন এর চোখে মুখে পুরোপুরি অবিশ্বাস, ওর মতো ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চলা কোনো ছেলেকে কোনো মেয়ে কথা নাই বার্তা নাই হুট করে ঝাড়ি দিয়ে বসতে পারে, এই সাহস তো ছেলেদেরও নাই, এমনটা বোধহয় সে স্বপ্নেও ভাবেনি, তাও আবার সুন্দরীর কাছে থেকে...! বাকি ছেলেরাও পুরাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো...আজকে যে কি হয়...শুকনা পাতলা একটা মেয়ের এতো সাহস!

নীনার বাবা চলে এসেছে, মোটরসাইকেলের শব্দ কানে গেলো, নীনা অপলাকে আস্তে আস্তে বললো চল যাই, এই টাইপের পাতি মাস্তান মার্কা ছেলের সাথে তর্ক করিস না, বলে ব্যাগ নিয়ে এগোলো, অপলাও এগোচ্ছিলো...

ঠিক তখনই ‘রবিন’ রাগের চোটে পালটা উত্তর দিলো,

‘আমার ইচ্ছে আমি গান গাচ্ছি, তোমার সমস্যা হলে তুমি বের হয়ে যাও, তুমি আমাকে মানা করার কে...?!
তুমি নিজেকে কি মনে করো...?! আয়নায় গিয়ে নিজেরে দ্যাখো গিয়া, হুহ...!!!’ আমাকে ঝাড়ি দিতে এসেছে...!

অপলার মেজাজ গেলো আরো বিগড়ে, সে ছেড়ে কথা বলার মেয়ে না, ‘তোমার ইচ্ছা হলে তুমি তোমার বাসায় গিয়ে গান গাও..., কন্সার্ট এ গাও, এখানে কি তুমি গান গাইতে আসছো...?! এইটা টিচারের বাসা..., আর যেই না গলা, হুহ...

‘রবিন’ ও পালটা বলে যাচ্ছে...
‘ক্লাস শেষ, সবাই চলেও গেছে, এখন আমি গান গাবো না নাচবো, সেটা আমার ব্যাপার, তোমার তো মাথা ঘামানোর দরকার নাই, তোমাকে এখানে থাকতে বলছে কে...?!

অভদ্র ছেলে, কোনো ম্যানার নাই বলে রাগে গজগজ করতে করতে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেলো অপালা।

বাকি ছেলেগুলো মিনিট খানেক পরে বের হলো। ‘রবিন’ এর মেজাজ তখন পুরাই সপ্তমে, নিচে নেমে রাস্তায় এসে বিড়বিড় করছে...‘আমারে ঝাড়ি দেয়, এই মেয়ে নিজেরে কি মনে করে...?! নাহ... ওরে আমি এক্ষণ ধরবো, ও আমারে উত্তর দিয়া যাবে...!!!’

সামনে তাকায়ে দেখে অপলা তখন রিকশা ঠিক করে মাত্র উঠছে, রবিন সোজা তেড়ে গিয়ে রিকশার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ালো, এই মেয়ে, তুমি কোন সাহসে আমার সাথে এভাবে ঝাড়ি দিয়ে কথা বললা...?! তুমি চিনো আমাকে...?! আমার ইচ্ছা গান গাবো না যা ইচ্ছা করবো, তোমার কি...?! আমি তো তোমাকে কোনো ডিস্টার্ব করি নাই...?!’

দিনে দুপুরে রাস্তায় রিকশার পথ আটকে রবিন এর এমন মারমুখী অভিব্যক্তি দেখে অপলা এই প্রথম একটু নরম হয় ... বড় বড় চোখ আরও বড় করে বললো, ক্লাসে বসে তুমি গান গাচ্ছিলা দেখে আমি মানা করছিলাম... ক্লাসে তো আমি আর নীনা ছাড়া আর কেউ ছিলো না, তাই মানা করছি! ঠিক আছে এখন গাও যত খুশি...

‘রবিন’ এর মাথা তখনো গরম, সে বললো তুমি রিকশা থেকে নামো, উত্তর দিয়ে যাবা..., নামো...

অপলা খুবই অবাক চোখে রবিনকে দেখছে, বিস্মিত, মনে মনে ভাবছে এই ছেলের সাহস এত হয় কি করে!
পরে পস্তানি সামলাতে পারবে?

এদিকে বাকি তিনজন ছেলে হা হয়ে দেখছে, ঠিক কি দিয়ে কি হলো কিছু বুঝে উঠার আগেই এতকিছু হওয়া সারা...!!! এখন অবস্থা খারাপ দিকে যাচ্ছে দেখে রবিনকে টেনে সরিয়ে আনে মিঠু, রিকশাওয়ালাকে ইশারা দেয় আগে বাড়ার জন্য। অপলার ফর্সা চেহারা রাগে, দুঃখে কষ্টে আরও যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

‘রবিন’ সরে আসলেও ওর রাগ যেন কমে না, গজগজ করতেই থাকে, করতেই থাকে...

অপলা বাসায় ফিরেই তার রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো,
এতক্ষণ রাগে দুঃখে মুখ ভার করে ছিলো, এখন চোখের কোনে রাজ্যের পানি জমা হলো... সোজা বাথরুমের দরজা খুলে বেসিন এর কল ছেড়ে পানির ঝাপ্টা দিলো চোখে মুখে, মুখ তুলে আয়নায় তাকিয়ে দেখতে পেলোকলের পানি আর চোখের পানির ধারা একাকার হয়ে নামছে...

এরপর থেকে ক্লাসে ঢুকলেই এদের অলিখিত শত্রুতা শুরু। একজন আরেকজন দিকে ফিরেও তাকায় না। একদম না। রবিন বসে পশ্চিম কোনায়, অপলা বসে পূব কোনায়।

কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।
(এমনকি এখনো তারা পূব আর পশ্চিমেই থাকে)

১০ মিনিটের ঝগড়া শেষ। কিন্তু রেশ থেকে গেলো জীবনভর! এরপর এসএসসি পরীক্ষার সময় চলে এলো, আপার বাসার ক্লাস শেষ হয়ে গেলো, সবাই যে যার মতো ছড়িয়ে পড়লো। তখন না ছিলো ফেসবুক না মোবাইল এর যুগ, কেউ কারোর আর খোঁজ পেলো না তেমন..

ক্লাস নাইনের সেই কিশোরবেলার এমন এক ঘটনা
এমন দুজনের মাঝে ঘটলো যার সাক্ষী শুধু তিনজন ছেলে যারা কেউই ভুলেনি...

এরপর ‘অপলা’ একদমই হারিয়ে গেলো, কোথাও পাওয়া যায়নি তাকে, কিন্তু সবার মনে থেকে গেলো। সবচেয়ে বেশি থেকে গেলো বোধ হয় ‘রবিন’এর মনে! কারণ এরপর থেকে সে শুধু অপলাকেই খুঁজে বেড়িয়েছে
এখানে সেখানে, সবখানে...

বহু বছর এইটা নিয়ে রবিনকে মিঠু পঁচাইছে...
তোর মতো একটা উড়াধুরা ছেলেকে একটা শুকনা পাতলা মেয়ে এভাবে ঝাড়ি দিলো...
তোর জীবনে এটাই মনে হয় প্রথম ঝাড়ি।

‘রবিন’ ও কম যায় না, বললো ঝাড়ি তো আমিও দিয়েছি....

মিঠু বললো, হয় কিন্তু সে আগে দিয়েছে, আর তোর ডোজ বেশি হয়ে গিয়েছিল...

‘রবিন’ বললো মেয়েটার ঠিকানা দিবি, কোথায় থাকে?
একদম মাথায় ঢুকে গেছে, কিছুতেই বের হয় না, কত যে খুঁজি, পাই না।

মিঠু অবাক হয়ে বললো, তু্ই খুঁজিস? ঝাড়িওয়ালি কে?
আমি জানি না তো ঠিকানা, সে কোথায় জানি হারিয়ে গেছে, আমিও তো খুঁজি অপালাকে

সময় নদীর মতো বহমান, কারোর তোয়াক্কা না করেই দু’পাড় ভেঙে সামনে আগায়...কেউ কারোর খোঁজ কেন জানি আর পায় না।

রবিন এখনো খুঁজছে, তার দৃঢ় বিশ্বাস একদিন খুঁজে পাবেই অপলাকে, বিভিন্ন গ্রুপে, বিভিন্ন পেজ এ সে অপলা নামের মেয়ে দেখলেই জিজ্ঞাসা করে, আপনি কি অমুক স্কুলের তমুক ব্যাচের সেই ‘অপলা’? উত্তর আসে, না ভাই, আমি সে না। রবিন এরপরেও খুঁজতে থাকে....

তাকে ঝাড়ি দেয় এই সাহস যেই মেয়ের আছে,
তাকে তো মনে রাখতেই হবে, খুঁজে পেতেই হবে! চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায়, সাদা ফিতে দিয়ে দুই বেণী করা, ঠোঁটের পাশে তিল, বেশ গভীর চোখের একটা ফর্সা পাতলা মেয়ে, জুতো জোড়াও সাদা ছিলো, কোথায় যে হারিয়ে গেলো... রবিন জানে একদিন খুঁজে পাবেই, খালি জানে না কবে!

এভাবেই কেটে গেছে ২৫ বছর, হুম ২৫ বছর!
হঠাৎ একদিন সকালে মিঠুকে ফোন করে রবিন ঘুম ভাঙালো, বললো চল স্টারে যেয়ে নাস্তা করি, অনেকদিন আড্ডা দেই না, মিঠু সময় ঠিক করে বললো আচ্ছা আসতেছি...

নাস্তা শেষে চা খেতে খেতে রবিন বললো ‘অপলা’ এর কোনো খোঁজ পেয়েছিস?

মিঠু বললো নাহ, তবে হালকা পাতলা শুনেছি, দেশে থাকে না বহুবছর, তু্ই এখনো অপলাকে খুঁজিস?

‘রবিন’ বলে উঠলো....

কখনো দেখবি, এক ঝাঁক পাখি এসে বসে মাঠে, ঘাস খুটায়, এদিক ওদিক চায়, এর মাঝে হঠাৎ করে একটা পাখিতে তোর চোখ আটকে যাবে, এরপর ওই পাখির ডানা, চোখ, পা, চাহনি সবকিছুই মনে গেঁথে যাবে, নিজে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মন লেগে যায়, মন পুড়ে যায়।
ঠিক তখনই হুট করে ডানা ঝাপ্টা দিয়ে পাখিটা উড়ে যায়,
ফেলে যায় মায়া...তীব্র মায়া...
এরপর জীবনে অনেক পাখি আসে, যায়....
কিন্তু ওই পাখি আর আসে না, মাথা থেকে যায় না।
মায়ায় ছটফট করতে থাকে হৃদয় মন, শান্তি লাগে না।

রবিন এখনো খুঁজে বেড়ায় অপলাকে

আর অপলা! থাক কিছু ঘটনা যে না জানাই যে ভালো।

এমআরএম/জেআইএম