ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

পদ্মার পলিদ্বীপ

ঘরভাঙা মানুষের জীবনের কড়চা

মো. ইয়াকুব আলী | প্রকাশিত: ০২:৫৩ পিএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩

আবু ইসহাক এই উপন্যাসে পরম মমতায় এবং চরম যত্নে নদীবিধৌত বাংলাদেশের এক বিস্তারিত চিত্র অংকন করেছেন। বাংলাদেশ নদীর দেশ। নদী তাই এখানকার সভ্যতা এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদীকে বাদ দিয়ে এসব অঞ্চলের ইতিহাস কল্পনা করা যায় না। বলা হয়ে থাকে নদীর একুল ভাঙে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা।

এই ভাঙাগড়ার খেলায় নদীর বুকে প্রায়শই জেগে ওঠে দ্বীপ। এই দ্বীপগুলো নদীর পলিমাটি দিয়ে আবৃত্ত। আর এগুলোর স্থানীয় নাম হচ্ছে চর। নদীর বুকে চর জেগে ওঠা মানেই যেন স্বপ্ন জেগে ওঠা। আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় মানুষ তখন বুক বাঁধে। নদী দুকুলের পাড় ভাঙতে ভাঙতে যখন জমির পরিমাণ কমিয়ে ফেলে তখন চরের জমি নদীর পাড়ের মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে। নতুন চরের দখল নেয়া নিয়ে তখন শুরু হয় কাইজ্যা।

কাইজ্যা অন্য একটি গোষ্ঠীকে হটিয়ে চরের দখল নেওয়ার নাম হলেও অনেকসময় সেটা খুনোখুনিতে রূপ নেয়। এমনই একটা চরের দখলের সয় দুই গোষ্ঠীর পাঁচজন মানুষ খুন হলে তার নাম হয়ে যায় ‘খুনের চর’ যদিও তার আগের নাম ছিল ‘লটাবুনিয়া’। লটা চরাঞ্চলের এক ধরনের গুল্ম জাতিয় ঘাস বিশেষ।

এই উপন্যাস প্রান্তিক মানুষের হাজার বছর ধরে চলা জীবন সংগ্রামের গল্প। এর ভাষা এবং শব্দভাণ্ডার আবহমান বাংলার প্রান্তিক মানুষের মুখের কথ্য ভাষা। এটা আঞ্চলিক ভাষার এবং আঞ্চলিতার উপন্যাস জলেও এখানে তখনকার সমসাময়িক পৃথিবীর চিত্রও লেখক তুলে ধরেছেন গ্রামীণ মানুষের বয়ানে। পাশাপাশি অন্যতম উপজীব্য হিসেবে এসেছে মানব মানবীর শ্বাশত প্রেম।

এই উপন্যাসের সময়কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক পৃথিবী। তখন আন্তর্জাতিকভাবে সবকিছু অস্থিতিশীল। চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মানুষের ক্ষুধা নিবারণের প্রধান উপকরণ ভাত তথা এই চাল। চালের দাম বাড়লে তাই জীবন যাপন হয়ে পড়ে কষ্টসাধ্য। তখন চালের যোগানের জন্য মানুষকে অবলম্বন করতে হয় অনেকরকম পন্থা। বাড়ির আঙিনায় চাষ করা বিভিন্নরকম সবজি তখন অনেকটা সেই শূন্যস্থান পূরণ করে।

এছাড়াও কৃষকের ছেলে জাল নিয়ে নেমে পড়ে মাছ ধরে কিছুটা বাড়তি আয়ের আশায়। কিন্তু গ্রামীণ জনজীবনে মাছ ধরা বা জাইল্যা পেশাকে দেখা হয় অত্যন্ত মানহানিকর হিসাবে। তাই সেটা করতে হয় লোকচক্ষুর আড়ালে।

আসা যাক উপন্যাসের কাহিনিতে। খুনের চরের জেগে ওঠা এবং তার দখল বেদখলের পূঙ্খানুপুঙ্খ বণর্না দিয়েছেন লেখক। পড়তে গেলে মনে হবে এগুলো যেন পাঠকের চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে। আর কাহিনির গতিময়তা এই পাঠকে একঘেয়েমি হতে দেয় না। চরাঞ্চলের উঠতি যুবক ফজলই এই উপন্যাসের নায়ক। তাকে ঘিরেই কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। সে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তাই তার চিন্তা ভাবনা অনেক উদার। কিন্তু গ্রামীণ নিয়মকানুনের বেড়াজাল এমনই যে সেটাকে ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব।

তার নামে মিথ্যা ডাকাতির মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। গ্রামাঞ্চলে এই মামলা এবং এর সাথে জড়িত পুলিশ এবং উকিল খুবই পরিচিত শব্দ। আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়ও এটা দেখেছি। আমরা তিনভাই তখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল পেশায় অধ্যয়নরত। তখন একদিন নানাবাড়ি পাবনার চর এলাকা ‘চরকাতরা’ থেকে মেজ মামা আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন।

এসেই কথাপ্রসঙ্গে যখন আমাদের বিষয় জানতে পারলেন তখন তিনি আক্ষেপ করে একটা কথা বলেছিলেন। সেটা হলো- ‘একটা ভাগ্নেও ব্যারিস্টারি পড়লো না, উকিলকে টাকা দিতে দিতে ফকির হয়ে গেলাম।’

গতিময় গল্পের পাশাপাশি এই বইয়ে আছে গ্রামীণ প্রকৃতির নিখুঁত বর্ণনা। উপন্যাসের শুরুর লাইন দুটো এমন- ‘পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। টুকরো টুকরো মেঘের ওপর লাল হলুদের পোঁচ। দপদপ করে জ্বলছে শুকতারা।’ আবার অন্য একটি জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘কালো রাট সারা গায়ে জোছনা মেখে কেমন মনোহরিণী হয়েছে।’ ‘বড় বড় নৌকা গুনের টানে উজিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে। কাঁধে বেরুয়া ঠেকিয়ে গুন টানছে মাল্লারা।’

‘আউস ধান পাকার সময় হলে আসুলি এলাকার তাল-বাবলা গাছের বাসা ছেড়ে ঝাঁক বেঁধে এগুলো আসে।...সময়ের মূল্য এ ছোট পাখিগুলোও বোঝে। তাই ওরা তাদের মতোই তৈরি করছে ভাওর ঘর।’ আরেক জায়গায় রাতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে, ‘টুকরো টুকরো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। যেন ধোপার কাপড় শুকোবার মাঠ। মেঘের ফাঁক দিয়ে তারা উঁকি মারছে। দিনের দুপুর থেকে রাতের দুপুর পর্যন্ত দাপাদাপি করে বাতাসের ডানা এখন ক্লান্ত। ক্লান্তি নেই শুধু পানির। গা দুলিয়ে নেচে নেচে কুলকুল গান গেয়ে অবিরাম বয়ে যাচ্ছে পানি।’

এবার চরের জীবনপ্রণালীর দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। বলা হয়ে থাকে, ‘চরের বাড়ি মাটির হাঁড়ি, আয়ু তার দিন চারি।’ চরের মাটির দলিল সম্পর্কিত আরেকটা কথা হলো- ‘চরের মালিকানা আবার রেকট-পরচা দিয়া সাব্যস্ত অয় কবে? এইখানে অইল, লাডি যার মাডি তার।’ চরে ফসল আবাদ করা নিয়েও একটা কথা প্রচলিত আছে- ‘ধান বোনে হাইল্যা, পেট ভরে বাইল্যা।’ মানে একজন শস্য বোনে কিন্তু তার ফসল ঘরে তোলে চরের অন্য কোন নতুন দখলদার।

এছাড়াও মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দারা বইয়ের ভাষায় আসুলিরা চরের মানুষদের সবসময়ই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। চরভাঙা এ সব মানুষের দিনের আশ্রয় রাস্তার বট-পাকুড় গাছের তলা আর রাতের আশ্রয় অফিস-আদালতের বারান্দা। চরের মাটি নিয়ে বহুল পরিচিত একটা গান হলো-

‘লাঠির জোরে মাটিরে ভাই
লাঠির জোরে মাটি,
লাঠালাঠি কাটাকাটি
আদালতে হাঁটাহাঁটি
এই না হলে চরের মাটি
হয় কবে খাঁটি...রে।’

এই উপন্যাস নিয়ে কিছু মূল্যায়ন তুলে ধরে লেখাটা শেষ করতে চাই। দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮৭ সালের ২৯শে অক্টোবর লিখেছিল ‘পদ্মার পলিদ্বীপ ব্যতিক্রমী চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, ভাষা বাকভঙ্গী নিয়ে এক অনবদ্য সৃষ্টি। সূর্য-দীঘল বাড়ী-তে যে আবু ইসহাক অপরিমেয় অভিজ্ঞতায় সমতলের সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রামের নিবিড় কাহিনি তুলে ধরেছিলেন; পদ্মার পলিদ্বীপে তিনি হয়েছেন আরো বেশি জীবনঘনিষ্ঠ, চরের সংগ্রামী মানুষের ব্যাথা বেদনায়, ক্রোধ-মমতায় আরো বেশি নিবিষ্ট। তাই পদ্মার পলদ্বীপে জীবন ধরা দিয়েছে কোন তন্ত্র কিংবা দর্শন নির্ভর করে নয়। এই উপন্যাসে চিত্রিত জীবন-সংগ্রামে নদীনালা-নির্ভর বাংলাদেশের এক উপেক্ষিত অথচ বৃহত্তর পরিধির আকাশ-বাতাস, ঘাস-জমিন, মাছ-ফসল, প্রকৃতি আবহাওয়া যেন কথা কয়ে গেছে একান্ত নির্লিপ্তভাবে।’

ইংরেজি পত্রিকা Independent এর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে লেখা হয়েছিল- ‘‘Though the total context and plot of Ishaq's second novel Padmar Palidwip is a different one, here the indomitable human spirit is also present as a theme as experienced in the first novel. The vast canvas encompassing the whole populace of the story's locality, their thoughts and feelings, love and hared, their invincible zeal and their defeat, gives the book an epic disposition.’’

এমআরএম/এএসএম