ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

আইএমএফের ঋণ এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি

প্রবাস ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৮:৪৭ এএম, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

প্রকৌশলী আব্দুল্লা রফিক

বাংলাদেশ সরকার সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) আইএমএফের কাছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের আবেদন করে। প্রথমে স্টাফ লেভেলের প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসে সরকারের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে মিটিং করে প্রাথমিক সবুজ সংকেত দিয়ে যায়, ১৩ জানুয়ারি শেষ হওয়া স্টাফ মিটিং থেকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য একটি শক্তিশালী মজবুত যুক্তিসংগত ‘টেকসই ঋণ পর্যালোচনা’ প্রতিবেদন তৈরি করে আইএমএফের বোর্ডে বিবেচনার জন্য দেওয়া হয়।

সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে আইএমএফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অন্তনিয়েট সায়া বাংলাদেশে আসেন এবং প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশের ব্যাংকের গভর্নরসহ আরও অনেকের সঙ্গে মিটিং করে স্টাফ মিটিং থেকে প্রদেয় রিপোর্টকে তার কার্যকরী মনে হয় এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই ইতিবাচক মন্তব্য করেন।

তিনি গত দশকের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক খাতের ব্যাপক উন্নতির প্রশংসা করেন এবং এর ফলে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার উন্নতি সাধন করে, সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, অনেক কম ‘ঋণ-জিডিপি’ অনুপাত, পর্যাপ্ত বাহ্যিক বাফার জোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তখনই ধারণা করা যাচ্ছিলো আইএমএফ বোর্ড বাংলাদেশ সরকারের চাওয়া ঋণ অনুমোদন দেবে।

তারপর আইএমএফ বোর্ড তাদের ৩০ জানুয়ারির মিটিংয়ে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অনুমোদন দেয় এই ঋণ সাতটি কিস্তিতে ৪২ মাস এ দেবে। আইএমএফের বর্ধিত তহবিল সুবিধা, বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা থেকে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার এবং আইএমএফের নতুন তৈরি করা স্থিতিস্থাপকতা ও টেকসই তহবিল থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম দেশ হিসাবে ১.৪ বিলিয়ন ডলার এর প্রতিশ্রুতি পায়।

এই ঋণের মধ্যে আইএমএফের ‘বর্ধিত তহবিল সুবিধা, বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা’, থেকে পাওয়া ৩.৩ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে, ভঙ্গুরতা থেকে রক্ষা করবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সবুজ প্রবৃদ্ধিকে মজবুত করবে, আর ‘স্থিতিস্থাপকতা ও টেকসই তহবিল’ থেকে ১.৪ বিলিয়ন ডলার পাওয়া ঋণ অতিরিক্ত তহবিল হিসাবে অর্থনীতির বিভিন্ন ছিদ্র পূরণে সাহায্য করবে।

কেন বাংলাদেশ সরকার আইএমএফের কাছে এই ঋণের জন্য আবেদন করে- করোনা মহামারির পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে খুব ভালোভাবেই অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করছিলো, হঠাৎ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তোলে, সরবরাহ চেইন নষ্ট হয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল/গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, নিত্যপ্রয়োনীয় জিনিসপত্রের দামও আকাশচুম্বী হয়ে যায়, বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার মান কমে যায়, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট শুরু হয়, সঙ্গে সঙ্গে রফতানি আয় কিছুটা কমে যায়, রেমিট্যান্স কমতে থাকে।

তখন বর্তমান সরকার সতর্কতামূলক অনেক পদক্ষেপ যেমন ধনীদের ব্যবহার জিনিসপত্রের ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা দেয়, রফতানি বাড়ানোর জন্য প্রণোদনামূলক মজবুত রফতানি উন্নয়ন তহবিল গঠন করে, আবার রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য ২.৫ শতাংশ হারে প্রণোদনার ব্যবস্থা করে।

সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে অর্থনীতির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঠিক রাখা, প্রাইভেট বিনিয়োগ আকর্ষণ, প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি, স্থিতিস্থাপক মজবুত পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আইএমএফের কাছে এই ঋণের জন্য আবেদন করে যেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শীটায় বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।

আইএমএফের শর্তাবলী: অভ্যন্তরীণ রেভিনিউ সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য ন্যাশনাল বোর্ড অফ রেভিনিউ বিভিন্ন নীতিতে এবং কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে কারণ জিডিপির তুলনায় জাতীয় রাজস্ব আয় অনেক কম, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও সর্বনিম্ন। এটা আসলে একটি চলমান প্রক্রিয়া, আর্থিক খাত পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ম্যানেজমেন্ট গঠন করতে হবে যারা অত্যন্ত দক্ষতা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে পাবলিক ফিন্যান্স, ইনভেস্টমেন্ট, ঋণ খাত পরিচালনা করতে পারবে, এটাও একটা চলমান প্রক্রিয়া।

পাবলিক সেক্টরের ভঙ্গুরতা কমাতে হবে, তদারকি বাড়াতে হবে, শক্ত রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করতে হবে, শক্তিশালী ক্যাপিটাল মার্কেট তৈরি করতে হবে। কাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে হবে, ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বাড়াতে হবে।

ধনীদের ওপর থেকে সাবসিডি কমাতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব ইনভেস্টমেন্ট করা অংশ বাদ দিয়ে করতে হবে যেটা কোনোভাবেই সমস্যা তৈরি করবে না কারণ এটা তো জাস্ট একটা নম্বর যা মানুষের মনস্তত্বের ওপর প্রভাব ফেলে বই কি। এর মধ্যে কোনো জটিল শর্ত আছে বলে আমার মনে হয় না।

বাংলাদেশের জন্য ঋণের বোঝা বাড়বে কিনা বা ঋণ বোঝা নিয়ে ভয়ের কিছু আছে কিনা- ২০২৬ সালে বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের গ্র্যাজুয়েশন হবে এবং ২০৩১ এর মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার টার্গেট নিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আর এজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থের দরকার।

ঋণ নেওয়াতে কোনো সমস্যা নেই যদি যেসব প্রজেক্টে ঋণ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়। প্রত্যেকটা প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পর ওই প্রজেক্টের ইনকাম দ্বারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ শোধ হবে আবার ওই প্রজেক্ট এর মাধমে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে, জিডিপি আকার বেড়ে যাবে, মানুষের ইনকাম বেড়ে যাবে।

এগুলো অর্থনীতির চলমান পক্রিয়া। কেউ কেউ হয়তো না বুঝে অথবা ইচ্ছাকৃত সাধারণ মানুষের ধারণার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে, তবে এগুলো খুব কার্যকর হবে বলে আমার মনে হয় না কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন দৃশ্যমান।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাহসী চিন্তার ফসল হিসাবে নেওয়া প্রজেক্টগুলোর কারণে বাংলাদেশের জিডিপি আকার আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ৪৬০ বিলিয়ন ডলার যেটা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার গঠনের সময় ছিল মাত্র ৯০ বিলিয়ন ডলার, এই চৌদ্দ বছর শাসনামলে মধ্যবৃত্ত থেকে একটা বড় অংশ উচ্চবৃত্তে ধাবিত হয়েছে যেটা বাংলাদেশে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

আইএমএফের বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার মতো বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারদের মতে, এখন পর্যন্ত ‘ঋণ ও জিডিপি’ এর অনুপাত যা আছে ‘রিস্ক’ এর কিছু নেই। কাজেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে বলেই আমার বদ্ধমূল ধারণা।

লেখক: প্রকৌশলী আব্দুল্লা রফিক
সাবেক প্রেসিডেন্ট
বাংলাদেশ কানাডা অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্যালগেরি

এমআরএম/এএসএম