হাইকমিশনে সাতদিনের কর্মসূচি
মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উদযাপন
‘থাকবো ভালো, রাখবো ভালো দেশ বৈধ পথে প্রবাসী আয়-গড়ব বাংলাদেশ’ স্লোগানকে সামনে রেখে তিন শতাধিক প্রবাসী নিয়ে মালয়েশিয়ায় উদযাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও যথাযথ মর্যাদায় বাংলাদেশ হাইকমিশন নানা আয়োজনের মাধ্যমে এ দিবসটি উদযাপন করে। রোববার (১৮ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় সেলাঙ্গর রাজ্যের ক্লাং-এ একটি হোটেলে দিবসটি উদযাপন করা হয়।
অনুষ্ঠানটি হাইকমিশনের ফেসবুক পেজে লাইভে অংশ নেন প্রবাসীরা। সভার শুরুতে প্রবাসী এবং দেশের উন্নতি কামনা করে মোনাজাত করা হয়। আলোচনা সভার সঞ্চালনা করেন কাউন্সিলর শ্রম মো. জহিরুল ইসলাম। তিনি হাইকমিশন থেকে সাত দিনের নানা কর্মসূচি সম্পর্কে তুলে ধরেন।
মালয়েশিয়ায় অভিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন, হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার। উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ খোরশেদ এ খাস্তগীর, কাউন্সিলর রাজনৈতিক ফারহানা আহমেদ চৌধূরী, প্রথম সচিব রাজনৈতিক রেহেনা পারভীন, শ্রম শাখার ২য় সচিব সুমন চন্দ্র দাসসহ দূতাবাসের অন্যান্যরা।
অনুষ্ঠানে মালয়েশিযার সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কোম্পানির নিয়োগ কর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। দিবসটি উপলক্ষে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির বাণী পাঠ করেন কাউন্সিলর কনস্যুলার জি এম রাসেল রানা, প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন পাসপোর্ট ও ভিসা শাখার প্রথম সচিব মিয়া মোহাম্মদ কিয়ামুদ্দিন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন প্রথম সচিব শ্রম এএসএম জাহিদুর রহমান, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন প্রথম সচিব বাণিজ্যিক প্রণব কুমার ঘোষ।
অভিবাসী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন, হাইকমিশনের মিনিস্টার শ্রম মো. নাজমুছ সাদাত সেলিম
সভায় হাইকমিশনার মো. গোলাম সারওয়ারের বক্তব্যের শুরুতে সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করেন দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোচনে প্রাণোৎসর্গ করা বীর সন্তানদের। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন। সেইসঙ্গে জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশের প্রবাসীদের মেধা, শ্রম ও দক্ষতা বিশ্বে প্রশংসিত। এ ধারা অব্যাহত রাখতে আমরা সচেষ্ট আছি। একই সঙ্গে প্রবাসীরা দেশ এবং নিজ দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
তিনি বলেন, এবারের অভিবাসী দিবসে আপনাদের কাছ থেকে নানান সমস্যা ও পরামর্শ সম্পর্কে নোট নিয়েছি এবং সেই অনুযায়ী কাজ করবো। আপনাদের এ বিদেশে আসা মানে আপনারা হিজরত করেছেন এবং এটি এক ধরনের ইবাদত। আপনারা নিজেদের কল্যাণে, পরিবারের কল্যাণে এবং দেশের কল্যাণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিবিষ্ট আছেন। এতবড় ত্যাগের জন্য প্রবাসীদের অভিনন্দন জানান তিনি।
অভিবাসী অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়া প্রবাসীদের মধ্য থেকে বক্তব্য দেন আরমান
রিহিয়ারিং প্রোগ্রামের আওতায় বৈধতা প্রাপ্তদের ৬নং ভিসাটি দ্রুত দেওয়ার জন্য অনুষ্ঠানে আগত মালয়েশিয়ান কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন এরই মধ্যে কূটনৈতিক মাধ্যমে ৬নং ভিসাটি দেওয়ার জন্য মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে।
হাইকমিশনার বলেন, করোনাকালীন মালয়েশিয়াব্যাপী লকডাউনের কারণে প্রত্যেকের জীবনে যে কঠোরতা নেমে এসেছিল সে সময় হাইকমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা কার্যক্রম চালু রাখেন। পাসপোর্ট সেবাকে যতদূর সম্ভব প্রবাসীর দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট আবেদন গ্রহণ ও পাসপোর্ট বিতরণের ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে প্রবাসীরা এর সুফল পাচ্ছেন। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের সেবার মান মূল্যায়ন করে দেখেছি এবং প্রবাসীদের কল্যাণে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছি। ইজি একসেস টু সার্ভিস অর্থাৎ প্রবাসীর সাথে হাইকমিশনের সহজ যোগাযোগ এবং সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশ সরকারের এমন নির্দেশনা আলোকে হাই কমিশন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
অভিবাসী অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়া প্রবাসীদের মধ্য থেকে বক্তব্য দেন সুমন
সভায় মালয়েশিয়া প্রবাসী ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আরমান বলেন, আমরা বর্তমানে হাই-কমিশন থেকে অনেক সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারছি। তবে পাসপোর্ট আনতে কুয়ালালাপুরে যেতে না হলেও থাকার জায়গা থেকে অনেক দূরে পোস্ট অফিসে যেতে হয় এবং দীর্ঘ লাইনে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই পদ্ধতি সহজ করার জন্য হাই কমিশন সু-দৃষ্টি দেবেন। বৈধ পথে টাকা পাঠাতে সকল প্রবাসীদের আহ্বান জানান আরমান।
প্রবাসী সুমন হোসেন বলেন, পাসপোর্ট দ্রুত পেতে এবং হাইকমিশনের কাজের গতি বৃদ্ধি করতে হবে। পাসপোর্ট করতে এখনও দূর-দূরান্তে যেতে হয়। এজন্য ছুটি নিতে হয় আর একদিন ছুটি কাটালে কোম্পানি কাজের টাকা দেয় না। আর সবাইকে বৈধ পথে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করেন সুমন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত মালয়েশিয়া প্রবাসীরা
বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ হাইকমিশনের মিনিস্টার শ্রম মো. নাজমুছ সাদাত সেলিম শ্রম পরিস্থিতি সম্পর্কে তুলে ধরে বলেন, এক কোটি ৪০ লাখের মতো বাংলাদেশি প্রবাসে কর্মরত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, তারা গত বছর প্রায় ২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করেছেন। রেমিট্যান্স প্রেরণে মালয়েশিয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে ৬ষ্ঠতম স্থান অধিকার করেছে। তিনি বলেন বৈধ পথে অর্থ প্রেরণ বৃদ্ধি করা হলে মালয়েশিয়ার অবস্থান আরও ওপরের দিকে থাকবে সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।
তিনি বলেন, বিদেশ গমনেচ্ছুক কর্মীরা যাতে দাদনদের দ্বারস্ত না হয় সেজন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। অধিকল্প মৃত কর্মীদের জন্য সরকার ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া চালু করেছে। প্রবাসী দেশে ফিরে নিজ পেশায় অভিজ্ঞতায় কর্মসংস্থান নিয়োজনে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত মালয়েশিয়া প্রবাসীরা
কোনো কারণে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে ফ্লাইট বিলম্ব হলে, ঢাকা বিমান বন্দরের পাশে প্রবাসীদের জন্য কম খরচে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাইকমিশনে সেবার মান বাড়ানো হয়েছে। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট আবেদন ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে দ্রুত পাসপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত ডাকযোগে ১ লাখ ১৫ হাজার পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া নিজ দেশে ফিরে যেতে ৩ হাজার ৫০ জন ও মালয়েশিয়ার জেল ও বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা বাংলাদেশিকে দ্রুত দেশে প্রেরণে ১ হাজার ৩০৬ জনকে হাইকমিশন থেকে ট্রাভেল পারমিট দেওয়া হয়েছে।
অভিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে হাইকমিশন আয়োজিত সাত দিনের নানান কর্মসূচি সম্পর্কে তুলে ধরেন কাউন্সিলর শ্রম মো. জহিরুল ইসলাম।
এদিকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ বছর ৭২৪ জন বাংলাদেশি নাগরিকের মালয়েশিয়াতে মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ৬৬০ জনের মৃতদেহ বাংলাদেশ হাইকমিশন ও তাদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হয়েছে। বাকি ৬৪ জন কোভিড হওয়ায় মালয়েশিয়াতে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
তিনি জানান, মালয়েশিয়ায় কর্মরত প্রত্যেক কর্মীকে বিমার আওতায় আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে দেশটির সোশ্যাল সিকিউরিটি অর্গানাইজেশনের (সকসো) মাধ্যমে ৬ হাজার ৪০৮ জন কর্মী ও তাদের পরিবারকে ২ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা ক্ষতি পূরণ এবং অন্যান্য সবিধাদি দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রম অধিদপ্তর ক্ষতিপূরণ বাবদ ৬০ লাখ রিঙ্গিত বাংলাদেশে পাঠিয়েছে।
মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সদস্য হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শ্রম মিনিস্টার বলেন, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সদস্য হলে একজন অবিবাসী কর্মী সরকারের প্রদও সুযোগ সুবিধা পাবেন।
অনুষ্ঠানে র্যাফেল ড্র বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করছেন হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার
মালয়েশিয়ায় নতুন করে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৭৫ হাজার চাহিদা পত্রের আবেদন পেয়েছে বাংলাদেশ হাই কমিশন এবং ১ লাখ ৫০ হাজার ছাড়পত্র দিয়েছে। এর বিপরিতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৫ হাজার কর্মী মালয়েশিয়াতে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছেন।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দেশে সর্বোচ্ছ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ৯ জন প্রবাসীর হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট ও সনদ তুলে দেন হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার। সম্মাননা পাওয়া প্রবাসীরাও আলোচনা সভায় তাদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তারা।
এছাড়া আলোচনা সভায় কয়েকটি রেমিট্যান্স হাউজের উচ্ছপদস্থ কর্মকর্তারাও তাদের বক্তব্যে, মালয়েশিয়া প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিটেন্স প্রেরণে আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে র্যাফেল ড্র বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়।
এমআরএম/এমএস