একজন ‘প্রবাসীর প্রত্যাশা’
যখন আমরা প্রবাস জীবন অতিবাহিত করি তখন সেই দেশেও বিদেশি আর নিজের দেশেও বিদেশি। অভিধানের ভাষায় প্রবাসীদের সংজ্ঞা দিতে গেলে শুধু এক লাইনে বলতে হয় ‘নিজ দেশের সমৃদ্ধির জন্য অন্যদেশে অর্থ উপার্জন করেন বা দেশের স্বার্থে কাজ করেন তারাই প্রবাসী।’
তাইতো কবি বলেছেন,
‘মা ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান সব দেশে ফেলে
ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে গেছে দূরদেশে চলে।
দিনে ঝরে গায়ের ঘাম রাতে চোখের জল
ভবিষ্যতের স্বপ্নে ওরা বাড়ায় মনের বল’
এই প্রবাসী শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের স্বাধীনতা। প্রবাস থেকে অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিরা মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বে জনমত গঠনে কাজ করেছিলেন। প্রবাসী সরকারকে অর্থের যোগান দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও এই হতভাগা প্রবাসীরা স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র স্বাদ পায়নি। প্রবাসীরা তাদের ঘাম ঝরানো রেমিট্যান্স মাস শেষ হওয়া মাত্রই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয় দৈনন্দিন খরচের খাতে। এতে ওই পরিবারগুলো দারিদ্র্য দূর করতে পারে। রেমিট্যান্স পাওয়ার পরে একটি পরিবারের আয় আগের তুলনায় ৮২ শতাংশ বাড়ে।
রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে বিনিয়োগের মাধ্যমে। প্রবাসীদের পরিবার-পরিজন অধিকাংশ গ্রামে বসবাস করেন। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় ও সঞ্চয় বাড়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বাড়ছে।
প্রবাসীরা রেমিট্যান্স প্রবাহের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সচল রাখেন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস হলো রেমিট্যান্স বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনীয় রিজার্ভ, জাতীয় অর্থনীতিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখে।
→ ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ৬.৯৩ লাখ মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশ গমন করছে।
→ ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪.৭৮ লাখ মানুষ বিদেশ গমন করে।
→ ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে করোনার কারণে প্রবাস যাওয়া অনেকটা স্থিমিত হয়ে তবুও প্রায় ২.৫ লাখা মানুষ প্রাবাসে গমন করে।
→ ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে মাত্র করোনাভাইরাস থেকে বিশ্বের মুক্তি হলে এখন ৪ লাখ বাংলাদেশি বিদেশ গমন করেছে।
দেশের অর্থনৈতিক খাতে প্রবাসীদের অবদান
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ প্রবাসে রয়েছে। তাদের পাঠানো অর্থ দিয়েই বাংলাদেশ নতুন সিংগাপুর বা এশিয়ার টাইগার ইকোনোমির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪৯৮১.৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ছিল তার আগের অর্থ বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানি খাত সবার শীর্ষে থাকলেও সার্বিক বিচারে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান তথা মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। কারণ পণ্য রপ্তানি বাবদ যে অর্থ উপার্জিত হয় এর একটি বড় অংশই কাঁচামাল আমদানিতে চলে যায়। কিন্ত জনশক্তি রপ্তানি খাত এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যার উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে।
দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণে রফতানি হয়, তার চেয়ে বেশি আমদানি হয়। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ঘাটতি হচ্ছে। রফতানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ বাড়ায় এ ঘাটতির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। এ ঘাটতি মেটাতে রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা রাখছে। দেশের মোট আমদানির মধ্যে ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ ব্যয় মেটানো হচ্ছে রেমিট্যান্সের অর্থ দিয়ে।
গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণের মধ্যে- ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ১২৮৪৩ দশমিক ৪৩ মার্কিন ডলার, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ১৪৪৬১ দশমিক ১৫, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ১৪২২৮ দশমিক ৩২, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ১৫৩১৬ দশমিক ০৯, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ১৪৯৩১ দশমিক ০০, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১২৭৬৯ দশমিক ৫, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ১৪৯৮১ দশমিক ৬৯, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৮৪১৯ দশমিক ৬৩, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১৫৪১৯ দশমিক ৪১, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২৪৫৭১ দশমিক ২৩ মার্কিন ডলার।
শুধু চলতি বছরে এপ্রিল মাসে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২ থেকে ২.৫ কোটি মানুষ প্রবাসীদের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে প্রায় বর্তমানে বিশ্বের ১৬৫টি দেশে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত আছেন বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী। সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্যের লিখিত প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ তথ্য জানান ২০১৮ সালে। বাংলাদেশের প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বৈদেশিক রির্জার্ভের মূল উৎস।
প্রবাসীদের হয়রানি
বাংলাদেশে প্রবাসীদের হয়রানির শিকার হয় শুরু থেকেই। বিজনেন্স স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেনীর একলোকের মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যেতে খরচ হয়েছে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। অথচ সরকার নির্ধারিত ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একজন মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো দেশে যেতে বাংলাদেশের তুলনায় ৪ থেকে ৫ গুন টাকা কম লাগে।
বেসরকারি এজেন্সির দৌরাত্ম্য থেকেই উদ্ভব হয়। বাংলাদেশ বিমানবন্দরে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয় প্রবাসীরাই। বিদেশের বিমানবন্দরগুলোর কথা নাইবা বললাম। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই আমাদের হয়রানি শুরু হয়। দালালদের দৌরাত্ম্য, মধ্যসত্বভোগীদের বাগরা দেওয়া। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি। বিমানের টিকিটের মূল্যবৃদ্ধিসহ সঠিক সময়ে বিদেশে এসে নির্ধারিত কাজ না পাওয়া। বাংলাদেশ মিশনগুলোর গাফিলতি, সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বিদেশে এসেও হয়রানির শিকার হয়, নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ হয়।
প্রবাসীদের দাবিসমূহ দেশ ও জাতির স্বার্থে পূরণ করা প্রয়োজন
১. জন্ম নিবন্ধন ও ভোটার আইডি কার্ডসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংশোধনের জন্য দূতাবাসে বিশেষ সেল চালু করা।
২. প্রবাসীদের মরদেহ বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ফ্রিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের পক্ষ থেকে যে অর্থ দেওয়া হয় মরদেহ সরবরাহ করার জন্য সেই বিলটি পরে দেওয়া হয় বিধায় এক শ্রেণির দালাল দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়ে যায়। মরদেহের সরবরাহের টাকা দেওয়া হয় তা যেন আগেই দেওয়া হয়। এতে উপকৃত হবে মৃত্যুবরণকারীর পরিবার। কিছু কিছু দেশে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে যে চাঁদা তুলে মরদেহ পাঠানো হয়েছে। দেশে পরে সরকারের পক্ষ থেকে যে বিলটি দেওয়া হয় তা ব্যক্তি বিশেষের পকেটে চলে যায়। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ক্ষতিপূরণের টাকা মৃত ব্যক্তির পরিবারকে দেওয়ার শর্তগুলো আরও সহজ করতে হবে যেন পরিবারটি সহজে ক্ষতিপূরণের টাকা পায়।
৩. প্রবাসীর রেমিট্যান্স পাঠানোর ওপর ভিত্তি করে ‘প্রবাসী পেনশন স্কিম’ চালু করা।
৪. প্রবাসীর স্বাস্থ্যবীমা (মেডিকেল ইন্সুরেন্স) নিশ্চিত করে প্রবাসে ও দেশে স্বল্প খরচে ভালোমানের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৫. দেশে সরকারিভাবে প্রতিটি জেলায় ও উপজেলায় প্রবাসী হাসপাতাল নিমার্ণ করার দাবি জানাচ্ছি। যেন প্রবাসী পরিবার স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন।
৬. প্রবাস থেকে দেশে ফেরত কর্মীদের স্বল্প সময়ের মধ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
৭. নারী কর্মীদের বিদেশে পাঠানোর জন্য এজেন্সিগুলো নির্ধারিত বয়স ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে কি-না অভিজ্ঞ, সৎ কর্মকর্তাদের দিয়ে তদারকি করা, গাফিলতি থাকলে এজেন্সির বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া।
৮. প্রবাসে অসহায় নারী শ্রমিকের জন্য দূতাবাসের আশ্রয় কেন্দ্রে সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি করে, তাদের অল্প সময়ের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
৯. প্রবাসী শ্রমিকদের মরদেহ দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারিভাবে দূতাবাসের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করা।
১০. প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য দূতাবাসের আইনি পরামর্শ ও সহায়তা কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করা।
১১. পাসপোর্ট নবায়ন করার জন্য আগের মতো কনস্যুলেট সেবা চালু করা, প্রবাসী সেবা কেন্দ্রগুলো মান বাড়ানোর বিষয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দিয়ে দৈনিক মনিটরিং করা।
১২. প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার জন্য দূতাবাস নিয়ন্ত্রিত একটি বাংলা স্কুল চালু রেখে এবং ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করলে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে নতুন প্রজন্ম।
১৩. বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রবাসীদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা।
১৪. এয়ারপোর্টে প্রবাসীদের সঙ্গে যথাযথ সম্মানপূর্বক কথা বলা, প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ককে শক্তিশালী করা, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তারা এয়ারপোর্টের নিয়ন্ত্রণ ও যেখানে প্রবাসীদের সমস্যা হবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া।
১৫. প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের মাধ্যমে বিশেষ সেল চালু করে তাদের লাগেজ গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
১৬. যেসব রেমিট্যান্সযোদ্ধা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দেশে টাকা পাঠান তাদের দেশে অবস্থানকালে পুলিশ প্রটোকলের ব্যবস্থা করা।
১৭. প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে প্রকৃত অর্থে প্রবাসীদের কল্যাণে ব্যবহার করার সুব্যবস্থা করা। যেন প্রবাসীরা সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে বিদেশ গিয়ে জীবন-জীবিকার মান উন্নয়ন দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো যারা বিদেশে ব্যবসা করতে চান তাদের যেন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে সহজশর্তে ঋণ দেওয়া হয়। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কার্যক্রমকে যেন অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালিত করা হয় এতে করে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি কমে যাবে।
১৮. বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত প্রবাসী আসনের ব্যবস্থা করা।
১৯. প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রবাসী নীতি প্রণয়ন করা।
২০. ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে প্রবাসীদের জন্য ঢাকায় আবাসিক হোটেল চালু হতে যাচ্ছে তা যেন অ্যাপের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হয়।
২১. প্রবাস জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ প্রবাসীরা দেশর বিভিন্ন সেক্টরে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি।
২২. প্রবাসী ব্যবসায়ীদের সুবিধার্তে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটি বড় বাধা তা নিরসনে আইনগত পরিবর্তন আনা।
২৩. প্রবাসী লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিকদের ডাটাবেইজের অন্তর্ভুক্ত করা।
২৪. প্রবাসে বাংলাদেশি নাগরিক হামলার শিকার হলে দূতাবাসের মাধ্যমে আইনজীবী নিয়োগ করে আইনি সহায়তা দেওয়া।
২৫. দ্বৈত নাগরিক আইন বহাল রাখা। অন্যথায় প্রবাসে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে ভুলতে বসবে।
প্রবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা দাবি-দাওয়া সঠিকভাবে যদি আদায় করা হয় তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রবাসীদের অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে তাদের পরিবার বাজার কাঠামোতে অর্থ বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে।
প্রবাসে থাকা একজন মানুষের সবচেয়ে বড় যে টান তা হলো নাড়ির টান। এই টানের কারণে একজন প্রবাসীকে দেশ নিয়ে ভাবায়। মানুষের ভেতরে দেশ নিয়ে বোধ জাগে তখন যখন সে দেশের কথা ভাবে, দেশ নিয়ে ভালো কিছু চিন্তা করে, দেশের জন্য নিজের শান্তি বিসর্জন দিয়ে কষ্ট বেছে নিয়েও প্রবাসে থাকে। দেশের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পায় কিংবা নিজের ভেতরে দেশকে খুঁজে পায়।
যে খুঁজে পাওয়ার মধ্যেও থাকে গাঢ়-গভীর মমতাবোধ। যে মমতাবোধের টানে কেউ দেশে ফিরে আসে। দেশের মানুষ দেশ ছেড়ে কি আর বিদেশ শান্তি পায়। নিজের দেশে যতটা স্বাধীনতা নিয়ে চলাফেরা করা যায়, যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাওয়া যায় সেটা কি আর অন্যদেশে সম্ভব?
বা সম্ভব হলেও সম্ভবপর তৃপ্তিটুকু মনে আসে না বা এলেও নিজের কাছে ভালো লাগে না। ভালোলাগার তৃপ্তি পূর্ণ হয়ে গেলেও না। তার একটাই কারণ বিদেশে যা কিছুই করুক না কেন প্রবাসীরা তাদের শুধু একটা কথাই মনে হয় যে, এই দেশটা তো আমার না! কিন্তু তবুও সেদেশে নিজের দেশকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, নিজের দেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সে দেশের কাজ, সে দেশের সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। আহারে কী নিঃস্বার্থ এগিয়ে যাওয়া।
প্রবাসীরা যদি এমনভাবে এগিয়ে না যেত তাহলে আমাদের দেশ এখন যে পরিচিত পেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তখন এটাও পেত না। এই পাওয়ার অবদান পুরোটাই প্রবাসীদের। যে প্রবাসীরা কি-না রাত কী দিন না ঘুমিয়ে দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা মাথায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে সে প্রবাসীদের মূল্য দেশে যেমন থাকা উচিত তেমনই দেশের বাইরেও থাকা উচিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বড় হতাশার বিষয় তাদের কোনো মূল্য, তাদের কোনো সম্মান আমাদের দেশে নেই।
প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ
প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের কথা যদি বলি তবে আমি বলব তাদের কোনো সুখ নেই বরং দুঃখেরও কোনো শেষ নেই। কেননা তারা না ঘুমিয়ে, সময়মতো না খেয়ে, ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তাদের বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা, স্ত্রী-সন্তানের জন্য ভালোভাবে জীবন কাটানোর জন্য কিছু সময় নিয়ে আসা এটাই যেন তাদের কাছে বড় পাওয়া বলে মনে হয়।
দেশে প্রবাসীদের গুরুত্ব
আমাদের দেশের কথা যদি বলি দেশে প্রবাসীদের কোনো গুরুত্ব নেই, আছে অবহেলা। একজন প্রবাসী দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে অবহেলা সহ্য করে আত্মসম্মানের বোধ ত্যাগ করে কাজ করেন। আমাদের দেশে প্রবাসীদের মূল্য শূন্য।
প্রবাসীদের ভাবনা
আমার মা ভালো আছে তো! আমার বাবা ভালো আছে তো! আমার সন্তানরা ভালো আছে তো! এই ভাবনাগুলো তাদের আরো ভাবিয়ে তোলে যে, তাদের যত কষ্টই হোক না কেন তাদের উপার্জন করতে হবে। তখন তারা বুকে পাথর চাপা দিয়ে কাজে নেমে যায়, যে নেমে যাওয়ার মধ্যে আর কোনো দ্বিধা থাকে না, দ্বন্দ্ব থাকে না, থাকে শুধু একটাই ভাবনা যে, আমাকে ভালো কিছু করে দেশে গিয়ে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। যে ফোটানোর মধ্যে কোনো ক্লান্তি থাকবে না, ক্লেদ থাকবে না, তৃষ্ণা থাকবে না, থাকবে না এর কোনোকিছু।
কেননা তারা তাদের কথা ভেবে প্রবাসে যায় না, তারা তাদের পরিবারের কথা, দেশের কথা ভেবে বিদেশ যায়। গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়। দেশ থেকে একজন মানুষ যখন প্রবাসে যায় তখন তার ভাবনায় সবচেয়ে আগে যে ভাবনাটা থাকে সেটা হলো আমাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যে অর্থ দিয়ে আমি বিদেশে এসেছি আমাকে তা শোধ করে পরিবারের জন্য কিছু নিয়ে দেশে ফিরতে হবে। যে ফেরার মধ্যে থাকবে মমতা বা পাওয়ার ফেরা এবং তার কোনো কিছুর পাওয়ার ইচ্ছা পূরণের আকাঙ্খা।
দেশের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্ক
দেশের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্ক গভীর হয়েও গভীর হতে পারে না, তার কারণ প্রবাসীদের কখনোই দেশ সম্মানের চোখে দেখে না বা তাদের মূল্যবোধের জায়গাটা দেয় না। কারণ প্রবাসীরা দেশের বাইরে থাকে বলে। প্রবাসীরা দেশের জন্য দেশ ছেড়ে যায় অন্য দেশে এটা বুঝলেও বোঝে না দেশের মানুষ।
বেশ বড় বড় মানুষ বলে, প্রবাসীরা দেশ ছেড়েছে দেশের প্রতি তাদের মায়া, দেশের প্রতি তাদের টান নেই বলে, কিন্তু তারা এটুকু বোঝে না বা এটুকু বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই যে, আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অভাবেই তারা দেশ ছেড়েছে, আমাদের দেশের মানুষজনদের ভালো রাখার জন্য তারা দেশ ছেড়েছে।
দেশ প্রবাসীদের ভুলে গেলেও প্রবাসীরা কখনো দেশের কথা ভোলে না, তারা ভুলতে পারে না, কেননা সে সেদেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সুতরাং বলা যায়, প্রবাসীদের সঙ্গে দেশে সম্পর্কটা ততটা বন্ধুত্বপূর্ণ না হলেও দেশের প্রতি প্রবাসীদের একটা টান আছেই শুরু থেকে। কেননা তারা তাদের আপনজনদের দেখা পাওয়ার জন্য যেখানেই যাক না কেন সবশেষে তাদের দেশেই ফিরে আসতে হয়, মা বলে ডাকার জন্য নিজের গ্রামটার মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি তাকে বার বার দেখায় যেন তার টান, দেশের প্রতি তার মায়া আরো তীব্র হয়ে ওঠে তার কাছে।
প্রবাসীরা হলো দেশের মোহর। যে মোহরের কারণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দেশ। তাই সরকারের উচিত প্রবাসীদের ভালো রাখার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বর্তমানে দেশের সংকটময় মুহূর্তে থেকে উত্তোলনের জন্য প্রবাসীদের দাবি বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। মূল প্রবন্ধ ‘প্রবাসীদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার ২০২২।
লেখক: তাইজুল ইসলাম ফয়েজ, কেন্দ্রীয় সভাপতি, ইউরো-বাংলা প্রেস ক্লাব
ই-মেইল [email protected]
এমআরএম/এএসএম