সিঙ্গাপুরে ৬০ সেকেন্ডে করোনা শনাক্ত
বিশ্বের অনেক দেশ আজ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে কিছু দেশ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কিছু দেশ সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় পরিস্থিতি আজ ভয়াবহ করে তুলেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সিঙ্গাপুর। দেশটির গবেষকরা করোনাভাইরাস শনাক্তের নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাত্র ৬০ সেকেন্ডে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা যাবে।
এরই মধ্যে এ যন্ত্রের মাধ্যমে সাময়িকভাবে কোভিড টেস্টের অনুমোদন দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দেশটির দ্য হেলথ সায়েন্সেস অথরিটির ওয়েবসাইটে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের (এনইউসি) অধীনে ব্রিদোনিক্স নামে একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত পরীক্ষার অভিনব এই প্রযুক্তিটি নিয়ে এসেছে। পরীক্ষামূলকভাবে এটি প্রথমে দেশটির মালয়েশিয়া সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ব্যবহারের কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটির একজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মাত্র ৫ থেকে ২০ সিঙ্গাপুর ডলারে এ টেস্ট সম্পন্ন করা যাবে। তবে সেটি নির্ভর করবে কী পরিমাণ মানুষ এটি ব্যবহার করছেন তার ওপর।
২০২০ সালে এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল বিদোনিক্স। তখন পাইলট ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকারিতা পাওয়ার কথা জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
সিঙ্গাপুরে গত কয়েক মাস কোভিড শনাক্তের হার শূন্য বা এক অঙ্কে থাকার পর সম্প্রতি করোনা শনাক্তের হার বেড়ে গেছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সামাজিক জমায়েতের ওপর নতুন করে এক মাসের কঠিন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া ও নেদারল্যান্ডসে অবশ্য এরই মধ্যে এ ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু রয়েছে। ব্রিদোনিক্সের পক্ষ থেকেও সিঙ্গাপুরের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় যেসব দেশগুলো সফল তার মধ্যে সিঙ্গাপুর একটি দেশ। আসুন জেনে নেই গত এক বছর সিঙ্গাপুর কি কি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে করোনা মোকাবিলায় সফল হলো-
১) শুরুতেই চায়না থেকে ফেরত ব্যক্তিদের ১৪ দিনের লিভ অব অ্যাবসেন্সে পাঠানো হয়। এই ১৪ দিন তারা বাসায় থাকবে। তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি ১৪ দিনের মধ্যে শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা না যায় তবেই কাজে যেতে পারবে।
২) প্রতিটি বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি এমনকি শপিংমলের সিঁড়ি, লিফট ক্যামিক্যাল স্প্রে করে ভাইরাসমুক্ত করা হয়।
৩) স্থানীয় ও অভিবাসী প্রত্যেকের দৈনিক ২ বার শরীরের তাপমাত্রা চেক করা হয়।
৪) কারো সর্দি, কাশি, জ্বর অর্থাৎ ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে আলাদাভাবে চিকিৎসা দেয়া হয় এবং পরীক্ষায় করোনাভাইরাস কনফার্ম হলে নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা করা হয়।
৫) কোনো এক গ্রুপের একজন বা কোনো বাসার একজনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেলে সে পরিবার বা গ্রুপের সবাইকে আলাদাভাবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে পর্যবেক্ষণ করা হয়। যাতে করোনাভাইরাস ছড়াতে না পারে।
৬) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সরকারি খরচে চিকিৎসা দেয়া হয়।
৭) কনস্ট্রাক ট্রেসের জন্য তারা ট্রেস-টুগেদার নামে একটি অ্যাপ চালু করে। তাছাড়া এখন ব্লু-পাশ নামে কনট্রাক ট্রেসের জন্য ডিভাইস দেয়া হয়েছে।
যার মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি কারো সংস্পর্শে গেলে খুব সহজেই কনট্রাক ট্রেস করে তাকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়।
৮) বিদেশফেরতদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের স্টেহোম নোটিশ দেয়া হয়। সর্বশেষ বিদেশফেরত সবাইকে সরকারি তত্ত্বাবধানে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হচ্ছে। এই ১৪ দিনের মধ্যে দুইবার সোয়াদ টেস্ট করে রেজাল্ট নেগেটিভ হলেই কাজে ফিরতে পারছে। এমনকি এখন ওয়ার্কপাশ বা এস-পাশ হোল্ডার কেউ সিঙ্গাপুর ফিরলে তাকে ২১ দিন কোয়ারেন্টাইন থাকতে হচ্ছে।
৯) ডরমেটরিগুলোতে যাতে ব্যাপকহারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য তারা ঝুঁকিপূর্ণ ডরমেটরিগুলোকে আইসোলেশন ঘোষণা করে।
১০) ডরমেটরিগুলোতে অস্থায়ী মেডিকেল বুথ গঠন করা হয়। যেখানে অভিবাসী কর্মীরা চিকিৎসা সেবা নিতে পারে।
১১) করোনাভাইরাসে আক্রান্তের চিকিৎসা সুবিধার জন্য এক্সপো, জাহাজ, আর্মি ক্যাম্প, হোটেল ও HDB ফ্লাটে অস্থায়ী বাসস্থান করা হয়। সেখানে শারীরিকভাবে যারা সুস্থ তাদের পর্যবেক্ষণ করা হয়।
১২) মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়।
১৩) নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়।
১৪) অভিবাসী কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাবার আগে করোনাভাইরাস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়।
১৫) প্রত্যেক শ্রমিকদের জন্য তিনটি অ্যাপ ডাউনলোড করা বাধ্যতামূলক করা হয়।
১৬) ডরমেটরিগুলো করোনাভাইরাসমুক্ত করার প্রতি জোর দেওয়া হয়। ডরমিটরিগুলোকে করোনামুক্ত ঘোষণা করা হয়।
১৭) যারা কাজে ফিরবে তাদেরকে প্রতি ১৪ দিন পরপর রুটিন রোস্টার টেস্টিং-এর ব্যবস্থা করা হয়।
১৮) মেরিন সেক্টরে কর্মরতদের প্রতি সপ্তাহে রোস্টার টেস্টিং-এর ব্যবস্থা করা হয়।
১৯) ডরমেমিটরিতে অবস্থানরত অভিবাসীদের জন্য কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। তারা ডরমেটরি থেকে শুধুমাত্র কাজের সাইটে যেতে পারবে। আর সপ্তাহে একদিন রিক্রিয়েশন সেন্টারে যেতে পারবে।
২০) সর্বোপরি সিঙ্গাপুরকে করোনামুক্ত করার জন্য ভ্যাকসিন প্রদান শুরু করা হয়। এখন মেরিন সেক্টর ও বিমান সেক্টরে কর্মরতদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে এই বছরের মধ্যে সবাইকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে।
সিঙ্গাপুর সরকার, বেসরকারি এনজিও, জনগণ ও রাজনৈতিক নেতারা একসাথে কাজ করার কারণেই তারা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফল।
এমআরএম/এএসএম