স্মৃতির পাতায় নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে আসা প্রায় চারমাসের বেশি হয়ে গেলেও পড়াশোনার পাশাপাশি কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারিনি। ইতোমধ্যে দেশটির রাজধানী শহর আমস্টারডামসহ প্রায় ৬-৭টি বড় বড় শহর চষে বেড়িয়েছি তবুও কোথাও কোনো কাজের সন্ধান মেলেনি। অনেক ব্যয়বহুল দেশ হওয়াতে যা সঞ্চয় ছিল তা শেষের পথে। তাই হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিলাম বিভিন্ন শহরে এবং পরিচিত মানুষজনের কাছে।
উপায়ন্তর না পেয়ে ইউরোপের অন্যদেশে যারা শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিচিত লোকজন ছিল সবাইকে নক দেওয়া শুরু করলাম। একেকজন একেক ধরনের পরামর্শ দিতে লাগল। বেলজিয়াম থেকে এক ছোট ভাই পরিচয় করিয়ে দিল অন্য এক লোকের সঙ্গ যে কিনা পর্তুগাল থাকে। আমার সঙ্গে পর্তুগালের সেই ভদ্রলোকের কথা হলো এবং জানাল তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবার নেদারল্যান্ডস থাকে। তার সঙ্গে কথা বলে আমাকে জানাবে শিগগিরই।
৩-৪ মাস পরে কাজ পাওয়ার আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে কেবল মাত্র ১০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি ছিল, যা বর্তমানে ২০ ঘণ্টা। তাই কাজ পেতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়েছিল। ছোট ভাইয়ের বন্ধু আরও জানাল তার বন্ধু পরিবার নিয়ে নেদারল্যান্ডস থাকেন এবং বন্ধুর সালা-বাবুর ভালো ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে এখানে। শুনে খুশি হলাম এবং আশান্বিত হলাম। কারণ যে কোনো জায়গায় নতুনদের কাজ পাওয়ার জন্য এমন প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তাছাড়া আমার মতো যারা ‘গুড ফর নাথিং’ মানে কোনো বিশেষ হাতের কাজ জানে না তাদের জন্য এ ধরনের লিংক আরও জরুরি। ইউরোপের প্রথম কয়েকমাসে বুঝতে সক্ষম হয়েছি এখানে কাজের মধ্যে কোনো শ্রেণি বিভাজন নেই। কিন্তু কোনো না কোনো কাজ জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে কাজ ব্যবস্থা করা খুবই কষ্টকর হয়ে যায়। তাছাড়া স্থানীয় ভাষা জানাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে।
অন্য সমস্যাও আছে এখানে। কাজ পেতে বয়স একটি বড় বিষয় এখানে, কারণ বয়স অনুযায়ী ঘণ্টা প্রতি বেতন নির্ধারিত হয়। ১৮ বছর থেকে ২৯ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সভেদে বেতন নির্ধারণ হয়ে থাকে। এই সময়ের মধ্যে যত কম বয়স বেতন ও তত কম হয়ে থাকে। আর ২৯ এর উপরে সবার সমান বেতন কাঠামো হয়ে থাকে একটু বেশিই। অভিজ্ঞতা, ভাষা ও বয়সের কারণেও আমার কাজ পেতে আরও একটু বেগ পেতে হচ্ছে।
আগেই ধারণা করেছিলাম প্রবাস জীবন অতটা সহজ হবে না। তাই কখনো হতাশ হইনি। চেষ্টা চালিয়ে গেছি কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকার ফলে হয়ে উঠেনি হয়তো। কারণ অনেক দূরের শহর থেকে কাজের অফার পেয়েছি কিন্তু দূরত্ব বেশি হওয়াতে সেখানে যোগ দিতে পারিনি। তাছাড়া বেশ কিছু কাজ পেয়েছি কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া কিন্তু ঘণ্টাপ্রতি কম মজুরির কারণে তাও ফিরিয়ে দিয়েছি।
কিছুদিন পরে নেদারল্যান্ডসের এক ভদ্রলোক আমাকে কল দিলেন এবং আমার সিটি থেকে প্রায় একশ মাইল দূরের খনিংগেন শহরে যেতে বললেন। আমার কাজের ব্যাপারে কথা হয়েছে সেই শহরের কয়েকজনের সঙ্গে এমনটি জানালেন। দেরি না করে পরের দিনই যেতে চাইলে তিনি সম্মতি দিলেন। নেদারল্যান্ডসে ট্রেন যোগাযোগ খুবই জনপ্রিয় এবং দ্রুত।
স্বাভাবিকভাবে তিনি আমাকে ট্রেন স্টেশন থেকে নিতে আসলেন। সরাসরি কথা হয়ে আরও ভালো লাগলো। সহজ সরল স্বভাবের মানুষ এবং খুবই অকপট। দশ মিনিটের কথোপকথনে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় আমার সঙ্গে শেয়ার করেছে। আমি এটিকে ভালো একটি দিক হিসেবে নিলাম কারণ আমাকে তিনি ইতোমধ্যে আপন ভাবতে শুরু করেছিলেন। যদিও আমি কিছুটা লজ্জা পাচ্ছিলাম তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো শুনে, কিন্তু সেটি তাকে বুঝতে দিলাম না।
বয়সে আমার বাবার বয়সী হলেও মনের দিক থেকে আমার চেয়েও কম বয়সী। সে আমাকে নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন সুবিধা ও অসুবিধা জানাতে লাগলেন। পথিমধ্যে রেড লাইট জোন পার হচ্ছিলাম। আমাকে প্রশ্ন করলো আপনি কি জানেন এটি কি? আমি তার এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তাই বলে দিলাম জানি না। যদিও রেড লাইট সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানি। কেননা নেদারল্যান্ডসের প্রায় সবকটি বড় শহরে এমনটি দেখা যায় এবং তা দেখার জন্য প্রতি বছর লাখ কোটি মানুষের সমাগম ঘটে এই দেশটিতে।
তিনি তখন আমাকে বললেন, শুধুমাত্র এই রেড লাইট ও বার ডিসকো থাকার কারণে তিনি দেশটিতে পড়ে আছেন। যাইহোক আমার তার ব্যক্তিগত বিষয়ের প্রতি অটটা মনোযোগ ছিল না। আমি হঠাৎ বলে উঠলাম কারও সাথে কি আমার কাজের ব্যাপারে কথা হয়েছে? তিনি জানালেন দু’জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি বললাম চলেন তাদের সঙ্গে আগে দেখা করি। তাই তিনি পর্যায়ক্রমে দু’জনের সাথে দেখা করিয়ে দিলেন।
দু’জনেই যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন কাজের কোনো সুযোগ তৈরি হলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন। তখন হুমায়ুন ভাই তার বাসায় আমাকে নিলেন এবং দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। এক ছেলে এক মেয়েসহ চারজনের সুন্দর পরিবার এবং চারজনই কাজ করছে। সবাই বাসায় ছিল এবং বেশ আন্তরিক মনে হলো। পরক্ষণেই হুমায়ুন ভাই আমাকে নিয়ে চললো কাছাকাছি একটি মার্কেটে এবং সেখান থেকে একটি জামা উপহার হিসেবে কিনে দিয়েছিলেন একদিনের পরিচয়ে।
বিকেলে নেদারল্যান্ডসের সর্ব উত্তরের সেই ক্ষণিঙ্গেন শহরটি ঘুরেফিরে আমি এবার ডরমেটরিতে ফিরে যেতে চাইলাম। সেই ভাই আমাকে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন এবং খানিকটা ভরসা দিলেন যেন কাজের জন্য চিন্তা না করি। সপ্তাহ খানিকের মধ্যে ফোন আসলো সেই ভাইয়ের কাছ থেকে এবং জানালেন ক্ষনিঙ্গেন পার্শবর্তী শহর আসানে একটি রেস্টুরেন্টে কাজের ব্যবস্থা হয়েছে যা আমার শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। যতদূরেই হোক কাজের ব্যবস্থা হয়েছে তাই অনেক।
আমি প্রথমে প্রস্তাব দিলাম যেই তিনদিন আমার ক্লাস থাকে না বিশেষ করে শুক্রবার, শনিবার ও রোববার কাজ করার আবেদন করলাম। সাহিন ভাই যিনি রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি জানালেন অন্তত একমাস যেন ফুলটাইম ডিউটি করি তারপরে সপ্তাহে যে কদিন মন চায় তা করতাম। রাজি না হয়ে কোনো উপায় ছিল না কারণ গত চারমাস বিভিন্ন শহরে অনেক চেষ্টা করেও কোনো কাজের সন্ধান মেলেনি। তিনি জানালেন আমার জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে তাই আর না করলাম না। কারণ নেদারল্যান্ডসে থাকার ব্যবস্থা করা বেশ জটিল এবং বিভিন্ন নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতে হবে যা সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল।
ঠিকানা অনুযায়ী চলে গেলাম সেই শহর এবং রেস্টুরেন্টে। স্টেশনে রেস্টুরেন্টের মালিকের ছোটভাই আসছিল তাই তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি। পরের দিন দুপুরের পর থেকেই কাজ শুরু করলাম। ‘কোহিনুর অব ইন্ডিয়া’ যা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসেবে পরিচিত কিন্তু পরিবেশন করা হয় মূলত বাংলা খাবার। এখানে সাধারণ বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ভালো চাপ থাকে কাস্টমারের। মূল শেপের হেলপার হিসেবে আমার কাজ এবং আমার মতো আরও একজন ছিল একই কাজের। আমাদের দু’জনের কাজ হচ্ছে মূলত প্রধান শেপকে সাহায্য করা।
কয়েকদিনের মধ্যে সবাই আমাকে বেশ পছন্দ করতে শুরু করল। বিশেষ করে শেপ এবং সেই প্রতিদিনই আমাকে কোনো না কোনো রেসিপি শিখিয়ে দিচ্ছেন যা আমার সহকর্মীর মোটেই পছন্দ নয়। বাংলাদেশি সেই ছেলেটা নেদারল্যান্ডসে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে আশ্রয়ে বা শরণার্থী হিসেবে আছেন। সরকার থেকে বিশেষ সুবিধা পেলেও অবৈধ এবং লুকিয়ে কাজ করছে এখানে। সব সময় আমার উপর এক ধরনের আদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চায় যা আমি মোটেই সুযোগ দিইনি প্রথম থেকে। ফলে দিনেদিনে সেই আমাকে তার শত্রু ভাবতে শুরু করলো।
বিশেষ করে সেই দীর্ঘ ৬ মাসের বেশি সময় ধরে কাজ করলেও শেপের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। পক্ষান্তরে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে শেপ আমাকে আপন করে নিয়েছে এবং বিভিন্ন কাজ ও রেসিপি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। তাই ব্যাপারটি সেই ছেলেটি ভালোভাবে নেয়নি। সপ্তাহখানেক পরে থেকে সে আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। মোটকথা আমাকে সেই মোটেই টলারেট করতে পারছে না। কাজের ১৭ দিনের মাথায় আমাকে কাজ থেকে নিষেধ করা হয় এবং জানিয়ে দিল আর কাজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
আমি জানার চেষ্টা করলাম কেন আমার সঙ্গে এমনটি করা হলো? একেএকে আমার সমস্ত অপরাধ বলতে লাগলেন মালিকের ছোট ভাই। প্রথম অপরাধ আমি অন্য একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজের জন্য গিয়েছি আরও ভালো বেতনের আশায়। কিন্তু মজার বিষয় ছিল আমি তখনই জানতে পারলাম যে এই শহরে আরও একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। দ্বিতীয় অপরাধ ছিল আমি মালিকের ডাচ স্ত্রীকে নিয়ে নাকি খারাপ মন্তব্য করেছি। মূলত আমার মালিকের স্ত্রী কে তা আমি জানিই না।
তাছাড়া আমার বিষয়ে নাকি কাস্টমার্স রিপোর্ট করেছে কিন্তু অবাক করা বিষয় ছিল আমি কখনও কাস্টমার সার্ভিস করিনি। এ রকম আরও কিছু অবান্তর অভিযোগ ছিল আমার নামে যা শুনে আমার চোখ কপালে উঠার অবস্থা। তার কথা শুনে আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আমার সাথের ছেলেটা এসব রটিয়েছে। আমি সেই দিনই ফিরে আসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে। আসার ২-৩ দিন পরে আমাকে আবার কাজে ফিরে যেতে অনুরোধ করলো এবং সেই ছেলেটিকে তিরস্কার করছে। কিন্তু আমার আর মনমানসিকতা ছিল না তাদের মাঝে ফিরে যাওয়ার।
এমআরএম/পিআর