প্রবাসীদের মিতব্যয়ী হওয়া উচিত
নিজের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও বিপদের দিনে অন্যের কাছে হাত না পাততে প্রত্যেকেরই মিতব্যয়ী হওয়াটা জরুরি, তবে প্রবাসীদের মিতব্যয়ী হওয়াটা অতীব জরুরি।
আমার এক পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন, যিনি মাস শেষে বেতন পাওয়ার পর যৎসামান্য বাড়িতে পাঠিয়ে সবই নিজের জন্য ব্যয় করতেন। জুয়া খেলা, মদ্যপান, বিদেশি মেয়েদের সাথে ফূর্তি সবই করতেন। তাকে এভাবে টাকা খরচ করতে দেখে একদিন বললাম, ভাই কষ্টের টাকা এভাবে খরচ না করলেও পারেন।
বাড়িতে না দেন অত্যন্ত নিজের জন্য সঞ্চয় করুন। উনি আমাকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, আমাকে জ্ঞান দেওয়া লাগবে না, নিজের চরকায় তেল দেন। আমার উপার্জিত টাকা কিভাবে খরচ করব তা কি আপনাকে বলতে হবে? সেদিন আমি লজ্জিত হয়ে আর কথা বাড়াইনি।
কয়েকমাস আগে সেই ব্যক্তিকে কোম্পানি বরখাস্ত করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে গিয়ে সে মারাত্ম গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। আমাকে একদিন কল দিয়ে আর্থিকভাবে সহযোগিতা চায়।
ভেবেছিলাম তাকে কটূ কথা বলব, কিন্তু তার অবস্থা দেখে আর বলা হয়নি। শুধু এটুকু বললাম বেহিসাবি খরচ না করে যদি কিছু কিছু সঞ্চয় করতেন তাহলে হয়ত আজ অন্যের নিকট হাত পেতে সাহায্য চাইতে হত না। সে আমার সাথে একমত হয়ে বলল, কে জানত ভাই কোম্পানি দেশে পাঠিয়ে দিবে আর আমি দুর্ঘটনার শিকার হব। সবই হলো নসিব ভাই।
আমি এমনিই একটু হিসেব করে খরচাপাতি করি। তবে আজকাল একটু বেশি। মনের মধ্যে ভয় হয় কোম্পানি যদি দেশে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে কে আমাকে দুই টাকা দিয়ে সাহায্য করবে? কার কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইব? আমার এই হিসেব করে খরচ করতে দেখে, কিছু লোক আমাকে দেখলে টিপ্পনী কেটে বলে, টাকা পয়সা আজ আছে কাল নেই, নিজের উপার্জিত টাকা যদি ইচ্ছেমত খরচ না করি, তাহলে এই টাকা পয়সা ইনকাম করার মানে কি? তাদের এই তামাশা দেখে আমি বিচলিত নই।
বরং ভালোই লাগে, এরা আর আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় খরচের সময় টাকা চাইবে না। হিসেব করে খরচ করলে যদি কৃপণ খেতাব পেতে হয় তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি আজ বেহিসাবি খরচ করে আগামীকাল অন্যের কাছে হাত পেতে চাইতে পারব না। অন্যের কাছে হাত পাতার চেয়ে কৃপণ খেতাব পাওয়া বহুত সম্মানের।
আমার এক বন্ধু বেতন পাওয়ার পর দুইদিন মোরগ পোলাও মাংস খেয়ে টেকুর তুলে খাটে ঘুমায়। সপ্তাহখানেক পর অন্যের কাছে হাত পেতে কোনো রকমভাবে ডালভাত খেয়ে সকলের অগোচরে ঘুমিয়ে পড়ে।
টাকা পয়সাকে ভালোবেসে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার করে চলা সহজ কাজ নয়। সবাই তা পারে না। কিছু লোক আছে হাতে টাকা এলে খরচ করার জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। আমার মতে যারা হিসেব করে খরচ করে তারা জ্ঞানী। কেবল মুর্খরাই বেহিসাবি খরচ করে দুইদিন পর অন্যের নিকট হাত পেতে চায়।
একবার আমি আর আমার এক বন্ধু বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন একজন অভাবি ব্যক্তি এসে সাহায্য চাইলে, আমি হিসেব করে তিন দিনের জন্য নিজের খরচ রেখে তাকে অল্প কিছু সাহায্য করলাম।
আমার বন্ধু কোনো হিসেব না করে নিজের কাছে যা ছিল তার সবই দিয়ে আমাকে বলে দান করার সময়ও এমন হিসেব না করলে হয় না। আমি বলেছিলাম, অন্যকে উপকার করতে গিয়ে নিজেকে পথে বসাতে পারব না। নিজের সর্বোচ্চ দান করার মাঝে গৌরবত্ম নাই, নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর দান করার মাঝেই গৌরবত্ম আছে।
ড. লুৎফর রহমান বলেছেন ‘পয়সার প্রতি মমতাহীন হয়ে বেহিসাবির মতো খরচ করলে বুদ্ধি ও ধর্ম নষ্ট হয়। পয়সাকে ঘৃণা করো না। পয়সার প্রতি অন্যায় মমতা পোষণ করে নিজেকে হীন করো না।
বিবেচক ও মিতব্যয়ী ব্যক্তি হিসেবি না হয়ে পারে না। তিনি ভবিষ্যৎতের ভাবনা ভাবেন। বর্তমানে ছোট ছোট আরাম ও সুখ ভোগের ইচ্ছাগুলোকে দমিয়ে রেখে তিনি সামনের শীতের দিনের কথা চিন্তা করেন।’
আমার আরেক বন্ধু বেতন পাবার পর সব টাকাই বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তারপর অসহায়ের মতো অপরের কাছে হাত পাতেন। একটা সময় দেখলাম পরিচিত অনেকেই তার কাছে টাকা পায়। সে সময়মত ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে লজ্জায় ঘর থেকে বের হয় না। পাওনাদাররা তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। কেহ কেহ তাকে মারার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
আমি সবাইকে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে, ঋন পরিশোধের ভার নেই। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে অন্যের কাছ ঋণ করার মানে কি? সবাই তো আপনাকে গালাগালি করে? সে সহাস্যে জবাব দেয়, পরিবারের সবাইকে খুশি রেখে নিজে গালাগালি শোনার মাঝেও আনন্দ আছে।
কয়েকদিন আগে সে বিয়ে করতে ছুটিতে দেশে যায়। একদিন আমাকে কল দিয়ে বলল, ভাই আপনি ঠিকই বলেছেন ঋণ করে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে আমার লাভ হয়নি। সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। কেহ বিশ্বাস করে না আমার কাছে যে টাকা নেই। সবাই ভাবে আমার নিকট লাখ লাখ টাকা আছে, বিয়ে করব বলে খরচ না করে গলা শুকাচ্ছি। ভেবেছিলাম সবাই আমাকে ভুল বুঝলেও বাবা বিশ্বাস করবে। বাবাকে বললাম বাবা আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই, কিছু টাকা দিন হাত খরচের জন্য। বাবা রেগেমেগে বলল, তুই আমার সাথেও মিথ্যা বলছিস? তোর কাছে না হলেও পাঁচ লাখ টাকা আছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, এইজন্য নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মিতব্যয়ী হওয়া দরকার ছিল। প্রতিমাসে যদি সব টাকা বাড়িতে না পাঠিয়ে অল্প অল্প সঞ্চয় করতেন, তাহলে আজ আপনাকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত না। সে নিজের ভুলের জন্য আফসোস করে লাইনটা কেটে দিল।
আমার মতে যে সমস্ত মানুষ বেহিসাবি খরচ করে নিজের ভবিষ্যৎতের কথা চিন্তা করে না। সে মুর্খের সমান। সে নিজেকে নিজে ঠকায়। মানুষ যদি একটু বুঝেশুনে খরচ করে তাহলে তাকে অভাবের দিনে অন্যের নিকট অসহায়ভাবে হাত পেতে টাকা চাইতে হত না। বেহিসাবি খরচ করে সে নিজের দুঃখ নিজেই ডেকে আনে।
আমার পকেটে টাকার পরিমাণ দেখে আমি খাবারের দোকানে খেতে যাই। নিজের সর্বোচ্চ ব্যয় করে রসনা বিলাসের কোনো মানে হয় না।
আমি ভালো পোশাক, দামি ঘড়ি, দামি জুতা ব্যবহার করি না। তাই অনেকেই আমার সাথে তামাশা করে। একদিন এক ছোট ভাই বলল, কম দামি পোশাক পরে ফকিরের মত জীবনযাপন করে কি লাভ? আপনি মারা গেলে তো সাথে করে সম্পদ নিয়ে যাবেন না। নাকি আপনার কবরে সম্পদ নিয়ে যাবেন?
আমি তাকে কি বলব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কারণ আমি এ ধরনের প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি জানি সে বেহিসাবি খরচ করে। তাই সে চাচ্ছে আমিও তারমত বেহিসাবি হয়ে উঠি। আজকাল বেহিসাবি খরচ করা মানেই স্মার্ট, কলিজা বড় বিভিন্ন খেতাব দেওয়া হয়। আর একটু হিসেব করে খরচ করলেই আপনি কৃপণ, আপনার ধন পিঁপড়া খাবে।
জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রচারিত এক তথ্য মতে, পৃথিবীতে প্রতি বছর ১৩০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়। অথচ বিশ্বের বহুসংখ্যক মানুষের এখনো নিয়মিত তিন বেলা খাবার জোটে না। শিশু থেকে বৃদ্ধ কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় বহু রাত কাটায়। ধনী ব্যক্তিরা যদি মিতব্যয়ী হতেন তাহলে পৃথিবীতে কোন দরিদ্র থাকত না। কোন শিশুকে না খেয়ে ঘুমাতে হত না।
আসুন মিতব্যয়ী হই। এর জন্য কৃপন খেতাব পাওয়া লজ্জার কিছু না।
ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর থেকে/এমআরএম/জেআইএম