মালয়েশিয়ায় বাধ্য হয়ে দেহ ব্যবসা : দালালদের খুঁজছে পুলিশ
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি মেয়েরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দেশটির যেখানে সেখানে মেয়েরা দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে বলে প্রায়ই শোনা যায়। ট্যুরিস্ট ভিসায় বা কারো স্ত্রী সেজে ডিপেন্ডেন্ট ভিসায়। গার্মেন্ট, রেস্টুরেন্ট অথবা ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে ওই মেয়েদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ওরা আর কেউ নয়, বাংলাদেশেরই।
এ চক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পায় না। বাংলাদেশি মেয়েদের মালয়েশিয়া নিয়ে বিভিন্ন ক্লাব অথবা মনোরঞ্জন (মোজরায়) ওই চক্র বিক্রি করে। বাংলাদেশের মেয়েদের চাহিদা বেশি বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। সরেজমিন কুয়ালালামপুরের প্রাণকেন্দ্র কোতারায়া বাংলা মার্কেটে দেখা গেছে, ওই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে খদ্দেরের অপেক্ষায়।
আরও পড়ুন>নারীর স্তন দেখার সময় কেন হিন্দু মুসলিম লাগে না, প্রশ্ন স্বস্তিকার
স্থানীয়দের অভিযোগের ভিওিতে মাঝে মাঝে দেশটিতে চিরুনি অভিযান চালায় প্রশাসন। এর আগে এমন অভিযানে বাংলাদেশিসহ আটক হয় তিন শতাধিক নারী। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে জড়িতদের নাম। চক্রের প্রায় ১৪ জন বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এ চক্রকে ধরতে এখনও মাঠে কাজ করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তবে তদন্তের স্বার্থে কারো নাম প্রকাশ করেনি সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে দূতাবাস। চক্রটি ধরতে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নেমেছে বলে দূতাবাসের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে ১০ বাংলাদেশি নারীকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করার অভিযোগে দেশটির এক গাড়ি চালককে অভিযুক্ত করেছেন আদালত। ৩১ জুলাই মালয়েশিয়ার দুটি সেশন কোর্ট তাকে অভিযুক্ত করে। মালয় মেইলের খবরে বলা হয়, ভিকটিম ও ১০ বাংলাদেশি এবং এক ভারতীয় নারীর মধ্যে তিন বাংলাদেশি নারীকে এখনও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। বাকিদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির নাম আজুরা আলভি। আলভি অ্যাপ এর মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিতে চালক হিসেবে কাজ করেন। সো লিয়ন নামে আরেক অভিযুক্তের সহায়তায় গাড়িচালক কুপ্রস্তাব দেয়। বর্তমানে আজুরা আলভি জামিনে রয়েছেন। তাকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পার্শ্ববর্তী থানায় রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে।
জীবনে সচ্ছলতা আনার জন্য একটি মেয়ে যখন মালয়েশিয়া আসে তখন তার চোখে মুখে থাকে রাজ্যের স্বপ্ন। অনেকের যুক্তি, ভালো মেয়েরা বিদেশে কাজ করতে আসে না। তাদের উদ্দেশ্য থাকে ভিন্ন। কিন্তু অনেক মেয়ের অভিযোগ, খারাপ কাজ করে পয়সা উপার্জন করতে চাইলে মালয়েশিয়া আসতে হয় না, তা বাংলাদেশেই সম্ভব। টেলিফোনে মিলি ও সাথী (ছদ্মনাম) জানায়, তাদের জীবন কাহিনি, যা মালয়েশিয়ার বহু বাংলাদেশি মেয়ের জীবন কাহিনিও প্রায় একই রকম বলে মিলির দাবি। ছদ্মনাম প্রকাশের শর্তে সেই মেয়েটির সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমি কেন নষ্ট হলাম’।
বাংলাদেশি মেয়ে মিলি (ছদ্ধ নাম)। গত কয়েক বছর আগে ট্যুরিস্ট ভিসায় আসে মালয়েশিয়া। সর্বসাকুল্যে খরচ পড়ে ১ লাখ টাকা। বর্তমানে থাকে কুয়ালালামপুরের নিলাই এলাকায়। কথা ছিল সে ভালো বেতনে কাজ করবে, মালিক থাকা খাওয়া ও ওয়ার্ক পারমিটের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এখানে এসে সে দেখতে পায় সব মিথ্যা। প্রতারণার জালে আটকে পড়ে তারা। ওলট-পালট হয়ে যায় তার স্বপ্ন। খুঁজে পায় এক অন্ধকার জগৎ।
ঘণ্টাখানেক টেলিফোন আলোচনায় দু’জন জানায়, তাদের একটি সুন্দর সংসার ছিল। স্বামী সন্তান ছিল। মিলি বছর দশেক আগে মা-বাবার অমতে অল্প বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল এলাকার এক ছেলেকে। বছর খানেক পর তাদের সংসারে ফুটফুটে একটি মেয়ে আসে। এরপর ধীরে ধীরে চুরমার হতে থাকে মিলির সুখের সংসার। স্বামী ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করতে থাকে। স্বামী ঠিকমতো কাজকর্ম করে না।
আরও জানায়, সংসারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। বিক্রি করতে হয় তার কিছু স্বর্ণালঙ্কারও। মিলি প্রতিবাদ করলে নেশাগ্রস্ত স্বামীর মারধর কপালে জোটে। শিশুর দুধ কেনা তো দূরের কথা ঠিকমতো সে ঘরেও ফেরে না। জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সেভাবে কি ভুল সে করেছে। মা-বাবার কাছেও মুখ তুলে দাঁড়াতে পারে না। শিক্ষিত মেয়ে মিলি বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজতে থাকে। অন্তত সন্তানের জন্য কিছু একটা করতে চায় সে।
চাকরির জন্য এখানে সেখানে ছুটেও লাভ হয় না। তারপর টাকার জন্য নেশাখোর স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা আরো যায়। একটা সময় পরিচয় হয় ঢাকার ছেলে জসিমের সাথে। তাকে সে ধর্মভাই বলে ডাকে। জসিমও কথা দেয় সে তার জন্য একটা পথ খুঁজে দেবে। মালয়েশিয়ায় যাতায়াত রয়েছে জসিমের। সে সুবাদে মিলিকে মালয়েশিয়া চাকরির প্রস্তাব দিলে মিলি খুশিতে আটখানা হয়ে পড়ে।
কখনো স্বপ্নেই ভাবেনি বিদেশ আসবে। বড় বোনের কাছে লুকিয়ে রাখা স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি ও ধারকর্জ নিয়ে মালয়েশিয়া ট্যুরিস্ট ভিসায় আসে মিলি। মেয়েটিকে রেখে আসে বোনের কাছে। কিন্তু মালয়েশিয়া এসে জসিমের কথা ও কাজে মিল খুঁজে পায় না সে।
জসিম তাকে তুলে দেয় বাবুল নামে এক প্রতারক দালালের হাতে। পাসপোর্ট গচ্ছিত থাকে বাবুলের কাছে। এদিকে ভিসার মেয়াদ শেষে হয়। এক ঘরে তার বন্দি জীবন কাটে। দেশে রেখে আসা মেয়েটির কথা মনে পড়ে। ইচ্ছা হয় দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বাবুলের কথা মতো তাকে চলতে হয়। বাবুল তাকে খারাপ প্রস্তাব দেয়, সাথী ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে।
বাবুল ও তার দুই বন্ধু এক রাতে মাতাল হয়ে সারা রাত তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। কোথাও বিচার দেয়ার পথ থাকে না তার। মিলি বুঝতে পারে তার ওই ধর্মভাই (?) বাবুলের কাছে তাকে বিক্রি করে গেছে। একদিন অপর এক বাংলাদেশি চাকরি দেয়ার নাম করে সেখান থেকে তাকে নিয়ে যায় পুচং এলাকায়। কিন্তু সেও চাকরি না দিয়ে তাকে সে ভোগ করে।
এদিকে কয়েক মাস হলো দেশে একটা টাকাও পাঠাতে পারেনি সে। এমনকি নিজের জন্যও টাকা উপার্জন করতে পারে না। ওই ছেলেটিই তার উপার্জনের পথ খুলে দেয়।
মিলি এখন সবার। টাকার বিনিময়ে সে এখন দেহ বিক্রি করে। কখনো পুচং, কখনো কাজাং হয়ে তারপর বর্তমানে নিলাইতে ৫টি মেয়ে একসাথে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। টেলিফোনে মিলি জানায়, এখন আমার টাকার অভাব নেই। মাসে ২ থেকে ৫ হাজার রিঙ্গিতও আয় হয়। অবশ্য বাংলাদেশি দালালরা এর একটা অংশ ভাগ পায়। ওরাই খদ্দের জোগাড় করে দেয়।
মিলি জানায়, মাঝে মধ্যে দালালরাই পুলিশের ঝামেলা থাকলে সেটা মেটায়। টেলিফোন আলাপে মিলিকে বলা হয়, অনেকের অভিযোগ আপনাদের এসব কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে আপনি কি বলবেন? প্রতিবাদী কণ্ঠে জ্বলে ওঠে সে। কেন, আমি কি বেশ্যাবৃত্তি করার জন্য মালয়েশিয়া এসেছিলাম না, চাকরি করতে এসেছিলাম?
যতগুলো মেয়েকে আমি দেখেছি তারা চাকরি করতে এসে বাংলাদেশি ছেলেদের কারণেই এদেশে এ পেশায় এসেছে। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে। তার সঙ্গে যোগ হলো সাথী নামের একজন। মিলি ও সাথী বলছে, মেয়েরা ছেলেদের কাছে গেলে বেশ্যা হয় আর ছেলেরা মেয়েদের কাছে গেলে হয় বাদশা।
আমাদের জন্য যদি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় তাহলে ছেলেরা কেন আমাদের কাছে আসে? তারা তো দেশে মা-বাবাকে টাকা না পাঠিয়ে ইন্দোনেশিয়ান মেয়েদের নিয়েও ফুর্তি করছে। কই কেউ তো বলছে না ওদের জন্য দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে যারা আমাদের নষ্ট বলে নানা মন্তব্য করে তারাই চোরের মতো আমাদের কাছে এসে তাদের ক্ষুধা মেটায়।
আমার কাছে রাতের অন্ধকারে বড় বড় বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও নামি-দামি বাংলাদেশি লোকও আসে। যদি এদের মুখোশ খুলে দেই তখন ওই ভদ্রলোকদের অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? দালালরা যখন মালয়েশিয়ায় লোক এনে এখানে সেখানে ফেলে রাখে, দুই নম্বরি কাজ করে, অপহরণ করে তখন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না?
আমরা পয়সার জন্য দেহ বিক্রি করলে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়? আমি কেন বেশ্যা হলাম? বাংলাদেশের ওই নরপশুরাই তো আমাকে বেশ্যা বানিয়েছে। আমি না খেয়ে দুদিন এদেশে কাটিয়েছি কেউ তো এসে বলেনি- বোন এই নাও ১০ টাকা দিলাম এটা দিয়ে খেও। যখন আমি শরীর খুলে দিলাম তখন ওদের টাকার অভাব হয় না। বেশ্যা কে, আমি না ওরা। তাহলে কেন আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হয়।
মিলির তীব্র অনুরোধ, দাদা আমার কথাগুলো আপনি পত্রিকায় তুলে ধরবেন। প্রশ্ন করা হয় এ পর্যন্ত দেশে কত টাকা পাঠিয়েছেন? তৃপ্তিমাখা কণ্ঠে জানায়, প্রায় ৫ লাখ। মেয়েটি এখন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে। দেশে একটা ছোট্ট জায়গা কিনেছি। দেশে যাবেন কবে? কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে মিলি জানায়, কবে যাব এখনো ঠিক করিনি।
কিশোরী মিনা (ছদ্মনাম) গত তিন মাস আগে দালাল জহুরুলের প্ররোচণায় মালয়েশিয়া আসে। মিনা এ প্রতিবেদককে জানায়, কুমিল্লার জহুরুল মালয়েশিয়ায় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ দেবে বলে আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে ঢাকা থেকে অন এরাইভেল ভিসায় ইন্দোনেশিয়া নিয়ে যায় মিনাকে।
ইন্দোনেশিয়া থেকে পানি পথে নিয়ে আসে মালয়েশিয়ার ক্লাংয়ে। সেখান থেকে তিনদিন পর নিয়ে আসে কুয়ালালামপুর শহরে। শহরে এনে রাজবাড়ির নূর ইসলামের কাছে জহুরুল মিনাকে বিক্রি করে। নূর ইসলাম মিনাকে বুকিতবিনতাং এলাকায় নিয়ে গিয়ে দেহ ব্যবসা শুরু করে। মিনা প্রতিবাদ করতে গেলে নূর ইসলাম তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে সাতজনের সঙ্গে তাকে বিছানায় যেতে হতো।
এ অত্যাচার থেকে বাঁচতে মিনা কৌশলী হয়ে ওঠে। একদিন সে নূর ইসলামকে বলল বর্তমানে মালয়েশিয়ার অবস্থা খুব খারাপ। প্রতিদিন ধরপাকড় চলছে। আপাতত একটি ট্রাভেল পাস করে রাখা দরকার। নূর ইসলাম রাজি হয়ে একদিন বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়ে আসে ট্রাভেল পাস নিতে।
ওই দিন দূতাবাস থেকে ট্রাভেল পাস না দিয়ে বলা হয় পরের দিন আসতে। মিনা পরের দিন যথা সময়ে দূতাবাসে আসার পর নূর ইসলাম তাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সন্দেহ হয় সংশ্লিষ্টদের। মিনা তখন কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের সব খুলে বললে পাচারকারীরা আঁচ করতে পেরে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
মিনাকে দূতাবাসের হেফাজতে রেখে ওই দিনই দূতাবাসের সহায়তায় স্থানীয় আম্পাং থানায় দুই নারী পাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মিনাকে দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
এদিকে দুই নারী পাচারকারীর বিরুদ্ধে থানায় মামলার পর মালয়েশিয়া পুলিশ তাদের খুঁজছে। মিনা মালয়েশিয়ায় কাজ করতে গিয়ে যেভাবে বিকৃত ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এ রোমহর্ষক বর্ণনায় স্তব্ধ প্রবাসীরা। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি দাবি করেছেন প্রবাসীরা।
এমআরএম/এমএস