ওমানে ভালো নেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা
ওমানে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি। ওমানজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ৮ লাখের মতো বাংলাদেশি। কাজের জন্য বেশিরভাগ শ্রমিককে থাকতে হচ্ছে শহরের বাইরে বা মরুভূমিতে। যদিও তাদের অধিকাংশেরই রুম অথবা সিট ভাড়া থাকে হামরিয়াতে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ শ্রমিকই ফ্রি ভিসায় পাড়ি জমাচ্ছে ওমানে। যেই কারণেই থাকছে না কাজের কোনো নিশ্চয়তা। নিজেদের কাজের সন্ধান করতে হচ্ছে নিজেদেরই। ওমানের হামরিয়াকে দ্বিতীয় বাংলাদেশ বলা হলেও এখন আর সেই আগের মতো ভিড় লক্ষ্য করা যায় না। আগে যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বিভিন্ন কোম্পানি থেকে শ্রমিক নিতে আসতো এই হামরিয়াতে, এখন সেখানেও তেমন কাজের সন্ধান মিলছে না।
একটা সময় বিভিন্ন কোম্পানির শ্রমিক নেয়ার জন্য জায়গাটিতে এসে জোরে ডাকাডাকি করলেও এখন আর সেই ডাকাডাকি লক্ষ্য করা যায় না আগের মতো। মূলত কাজ না যেনে দালালদের খপ্পরে পড়ে অবৈধ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার ফলেই ঘটছে এই ধরনের ঘটনা।
ওমানে প্রায় প্রতি শুক্রবারেই সন্ধ্যার পর পুলিশি তল্লাশি হয় হামরিয়াতে। যদি কেউ বুঝতে পারে পুলিশ আসছে, সে এমন এক শব্দ করে যাতে অন্যরা বুঝতে পেরে যে যার মতো এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়।
যারা পুলিশের হাতে আটক হয় তাদের বেশিরভাগ লোককে দেশে চলে আসতে হয়। অন্যথায় জেল খাটতে হয়, আর যাদের আরবাব (ওমানি স্পন্সর কে আরবাব বলে) ভালো, তাদের আরবাব থানায় এসে জরিমানা দিয়ে তাদের নফর (শ্রমিকদের কে ওমানে নফর বলে) ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন।
ভিটেমাটি বিক্রি করে প্রবাসে এসে এভাবেই অনিশ্চয়তার মাঝে দিন পার করেন বেশিরভাগ প্রবাসীরাই। শুধুমাত্র ওমানেই নয়, এই চিত্রটি গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই দেখা যায়। এই সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে-
১) না যেনে দালালদের লোভনীয় কথায় ফ্রি ভিসা নামক অবৈধ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া।
২) কাজ না জেনে অদক্ষ হিসেবে প্রবাসে যাওয়া।
৩) অতিরিক্ত টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া, (ওমানে একই কোম্পানিতে ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানিসহ অন্যান্য দেশের লোক নামমাত্র খরচে ভিসা পাইলেও বাংলাদেশিদের জন্য ২ থেকে ৩ লাখ লাগে)
কুমিল্লার মুহাম্মাদ দেলোয়ার, দুই বছর আগে দালালের লোভনীয় কথায় ফ্রি ভিসা নিয়ে ওমানে এসেছিলেন, এয়ারপোর্টে কাজ দেয়ার কথা থাকলেও ওমান আসার পর কাজ মেলে মরুভূমিতে। ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাজ করতে হচ্ছে এখন দেলোয়ারকে। মাস্কাট থেকে প্রায় ৮৫০ কিমি দূরে মারমুল পিডিও এরিয়াতে কাজ করেন তিনি, (ওমানের সব থেকে বেশি পরিমাণ খনিজ তেল এই মারমুল থেকেই উত্তোলন হয়)।
আশপাশে শুধু মরুভূমির বালু ছাড়া আর কিছুই নেই, কিছুদূর পরপর খনি থেকে তেল উত্তোলনে মেশিন ব্যতীত আর কিছুই দেখা যায় না। ৩ লাখ টাকা দিয়ে ওমানে এসেছিলেন তিনি। ব্যাংকের ঋণ ও পরিবারের কথা চিন্তা করে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে এখন, ওমানের মরুভূমিতে কনন্সট্রাকশনের কাজ করেন। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত শরীরে রাতে একটু শান্তিতে ঘুমাতেও পারেন না। মাঝেমধ্যেই পুলিশের তল্লাশী হয়, ধরা পড়লেই দেশে পাঠিয়ে দেবে, এই ভয়ে একটু শান্তিতে ঘুমাতেও পারেন না।
মোবেলা সানাইয়া শহরে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে কাজ করেন ফরিদপুরের মুবারক, চার বছর আগে এলাকার এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে ওমানে এসে প্রথমে মালিকের কাজ করলেও এখন অবৈধ। চুক্তি অনুযায়ী বেতন না দেয়া এবং মাস শেষে বেতন না পাওয়ার কারণে মালিকের থেকে পালিয়ে এখন অবৈধ হয়ে কাজ করছেন তিনি।
৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ও কঠোর পরিশ্রম করছেন মুবারক। সারাদিন কাজের মধ্যে পার করলেও রাত কাটে নানা দুশ্চিন্তায়! একদিকে পরিবারের চিন্তা অপরদিকে যে কোনো সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতারের ভয়।
সাধারণত গালফের অন্য দেশের তুলনায় ওমানিরা বাংলাদেশিদের বেশি সম্মান করে, সেইসঙ্গে বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় ওমানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও বেশি। বর্তমানে দেশটির বাংলাদেশি শ্রমিকরা তেমন ভালো নেই, সেইসঙ্গে যারা ব্যবসা বাণিজ্য করছেন, তাদের ব্যবসাও অনেক মন্দা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির বিশিষ্ট বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ ইয়াসিন চৌধুরী সিআইপি।
এমআরএম/এমএস