মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার : নতুন মলাটে পুরোনো ধান্দা
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে জনশক্তি প্রেরণ থমকে থাকায় বাস্তবে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কবে খুলবে এই বন্ধ দুয়ার তা দেশটির সরকার ছাড়া আর কেউ জানে না। মাহাথির মোহাম্মদের বর্তমান সরকার মালয়েশিয়ার উন্নয়নে কাজ করবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশিদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এখনও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের প্রচুর কদর রয়েছে। প্রফেশনাল ভিসা করে দেয়ার নামে নতুন মলাটে পুরাতন ধান্দা শুরু করেছে অসাধু চক্র।
আর এ অসাধু চক্রের বিভিন্ন জনের কাছে টাকা ও পাসপোর্ট দিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ ওঠেছে। মালয়েশিয়া সরকার সম্প্রতি প্রফেশনাল ভিসায় কাজ করতে আসা কর্মীদের সর্বোচ্চ ১২ মাস অর্থাৎ ১ বছরের জন্য ভিসা দেবে। এরপর কোম্পানি ইচ্ছা করলে কর্মীর ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করতে পারবে।
আবেদন এক্সপেট্রিয়েট সার্ভিস ডিভিশনে অনলাইনের মাধ্যমে করতে হবে। গত ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে এ নিয়ম কার্যকর করেছে। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশি ছাত্রদের ৬ মাসের জন্য ভিসা দেবে এবং ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করবে না। ফুড অ্যান্ড বেভারেজ রেস্টুরেন্ট/ক্যাফে/কনভেনশন সেন্টার ছাত্রদের প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত নয়। এসব শর্ত পূরণ না হলে ভিসা ইস্যু করবে না। বৈধপথে শ্রম রফতানি থমকে থাকায় ধান্দাবাজরা সাধারণ মানুষদের কাবু করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার আটছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশের অসাধু চক্র মালয়েশিয়ার নাগরিকদের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দাতু উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে ভুয়া কোম্পানির প্যাড তৈরি করে অভিবাসন বিভাগের ভুয়া ওয়েবসাইট খুলে প্রফেশনাল ভিসার লিমিট ১শ জন /২শ জনের অনুমোদন পেয়েছে এ রকম কাগজ দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এদিকে প্রফেশনাল ভিজিট পাশের (পিভিপি) নামে বিদেশ থেকে অযোগ্যদের মিথ্যা কাগজপত্র দিয়ে এক্সপার্ট হিসেবে প্রফেশনাল বানিয়ে মালয়েশিয়া প্রেরণ করে। এরা প্রকৃতপক্ষে কোনো কোম্পানির অধীনে থাকে না, নিয়মানুযায়ী আয়কর প্রদান করে না, এ কারণে পরের বছর ভিসা বর্ধিত করতে পারে না। ফলে অবৈধ হয়ে যায়। স্টুডেন্ট ভিসার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন হোটেল/রেস্টুরেন্ট এ প্রশিক্ষণার্থী ছাত্র হিসেবে ৬ মাসের স্টুডেন্ট ভিসা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রেরণ করে। ছয় মাস পর এই ভিসা মেয়াদ বৃদ্ধি হয় না। ফলে তারাও অবৈধ হয়ে যায়।
এ বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ফলে অবৈধ নাগরিকদের পাশাপাশি নানা এজেন্ট ও দালালদের গ্রেফতার করছে। উল্লেখ্য, পিভিপি এবং প্রশিক্ষার্থী স্টুডেন্ট ভিসায় প্রেরণের ক্ষেত্রে বিএমইটি বা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি যেমন লাগে না তেমনি হাইকমিশন থেকে সত্যায়নের প্রয়োজনও হয় না। ফলে কারা কোন ভিসায় কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে তা নির্ণয় করা যায় না। ফলে এসব কর্মী সরকার নির্ধারিত মাইগ্রেশন নিয়মের বাইরেই থেকে যায়। এ বিষয়ে দেশ ত্যাগের পূর্বে খোঁজ নিয়ে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ওয়েবসাইটের এই লিঙ্কে ক্লিক করলে দেখা যাবে এসব নামে মালয়েশিয়া সরকার কোন ভিসাই দেয় না। ভিসাটির প্রকৃত নাম Employment Pass এখন ইংল্যান্ডের HSMP (Highly Skilled Migrant Program) বা কানাডার FSWP (Federal Skilled Worker Program) বা আমেরিকার L1AITM (Intercompany Transferee Manager)। এসব ভিসাকে কি Work Permit নামে ডাকলে চলবে?
সুযোগ-সুবিধা ও নিয়ম-কানুন কি একই হবে? নিশ্চয়ই না। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। এমনকি ডিপি ১০ ভিসা নামেও মালয়েশিয়াতে ভিসা প্রদানের কথা বলা হয়, অথচ ডিপি ১০ হলো একটি Application Form এটি কোনো ভিসাই নয়। Employment Pass বলতে সাধারণভাবে বোঝা যাচ্ছে এটি একটি Pass ev Vis যা দেয়া হয় Employment এর জন্য। কিন্তু কোথায় Employment এর জন্য? যে কোন কোম্পানিতে? কোম্পানিটি কি পুত্রজায়া থেকে গঠিত নাকি লাবুয়ান থেকে পরিচালিত International কোম্পানি? উভয়ের Minimum Paid UP Capital কত? বছর শেষে কোম্পানির Share Holder Employee Tax এবং Employment Pass কার কত? একটি কোম্পানি থেকে কতজনের Employment Pass পাওয়া যেতে পারে?
‘দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কতিপয় Online News Portal ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে ভুল ও অসত্য তথ্য সরবরাহ করে। আমাদের সবার উচিত মানুষকে সঠিক Information এর জন্য সরকারি Website দেখতে অনুপ্রাণিত করা। মালয়েশিয়ায় ইমিগ্রশন বিষয়ক যাবতীয় সরকারি সংস্থার Address এখানে তুলে ধরা হলো: -nj:http://www.lfsa.gov.my/
মালয়েশিয়ায় কয়েক লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে দু’দেশের সরকারি পর্যায়ে অর্থাৎ জি-টু-জি পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে শুরু করে মালয়েশিয়া। মূলত ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে জি-টু-জি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় লোক নেয়া শুরু হলেও শুধু প্লান্টেশন প্রজেক্টে কাজ করতে আগ্রহ কম থাকায় জনশক্তি রফতানির হার ছিল কম।
পরে মালয়েশিয়া জনশক্তির জন্য বাংলাদেশকে তাদের ‘সোর্স কান্ট্রির’ তালিকাভুক্ত করে। ফলে সেবা, উৎপাদন, নির্মাণসহ অন্যান্য খাতেও বাংলাদেশি কর্মী নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।’
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানির সঙ্গে যুক্ত কিন্তু সুযোগ সন্ধানী এজেন্সি মালয়েশিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় নিয়ম বহির্ভুতভাবে বাড়তি অর্থ আদায় করে কর্মী পাঠানো শুরু করে।
প্রকৃত অর্থে মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা, উন্নয়নের স্থপতি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় না আসলে হয়তো মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারি মদদপুষ্ট আদম ব্যবসায়ীদের রাহুগ্রাস বন্ধ হতো না। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক সরকারের সময় বাংলাদেশ সরকারের তরফে সব এজেন্সিকে লোক প্রেরণের ক্ষেত্রে সুযোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলেও কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো ১০ কোম্পানির সুযোগ-সুবিধাকে বেশি করে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে ৪০ হাজার টাকার স্থলে ৩/৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা আক্ষেপ করে বলেন, ‘মিথ্যা পরিচয়ে অযোগ্য লোক প্রেরণের ফলে এরা যেমন প্রতারণার শিকার হচ্ছে, অবৈধ হচ্ছে তেমনি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ কমিউনিটির দুর্নাম হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারকে আইনের বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করেন এ কমিউনিটি নেতা।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘দেশের সমৃদ্ধির জন্য প্রবাসী আয় একটি সম্ভাবনাময় খাত। প্রতি বছরই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশে আসে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন ১ কোটিরও বেশি। প্রতিবছরই দেশে নতুন করে প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে। যে হারে জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে, সে হারে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।
ফলে বেকারের হার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সরকারি কিংবা বেসরকারি যে খাতেই হোক এ দেশের বেকাররা কাজ করে বাঁচতে চায়। কিন্তু সে আকাংঙ্খা বেশির ভাগ পূরণ না হওয়ায় পরিবার ও দেশের মায়া ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে ওঠছে যুব সমাজ।
এ অবস্থায় সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাতে পারলে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রফতানি বাড়ানো গেলে এ আয় আরও বাড়বে। এ জন্য সরকার মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে কর্মী প্রেরণে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- এটাই কর্মমুখী মানুষের প্রত্যাশা।
এমআরএম/জেআইএম