ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

লেবাননে ‘নিরুপায়’ হয়েই দেহ ব্যবসায় বাংলাদেশিরা

বাবু সাহা | প্রকাশিত: ০৫:৫১ পিএম, ০২ মার্চ ২০১৯

লেবাননে দেহ ব্যবসায় জড়িত এমন দুই নারীকর্মীর সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, ‘আমরা এ দেশে কন্ট্রাক ভিসায় আসি। পরে দালালের খপ্পরে পড়ে পালিয়ে বাইরে চলে এসে অবৈধ হয়ে পড়ি। উপায়ন্তর না দেখে এক সময় অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ি’।

সীমা (ছদ্মনাম) নামের আরেক নারী বলেন, ‘আমি কন্ট্রাক থেকে বাইরে পালিয়ে এসে যে ভুল করেছি। এখন সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছি। অন্য কেউ যেন এ ভুল না করে।’

লেবাননে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন দালালের খপ্পরে পড়ে বিপদে পড়ছেন। প্রায় ৪০ লাখ মানুষের দেশ লেবাননে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজারের অধিক বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। তাদের মধ্যে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। লেবাননে কাজ করতে এসে দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। ফলে সাধারণ প্রবাসীরা নানা সমস্যায় পড়ছেন।

লেবাননের বুরুজ হাম্মুদ, ছাবরা বাজার, নাভা, এন্তালিয়াস, জলদ্বীপ, হাইসিল্লোম, আলকুলা, রাবেয়াসহ আরও অন্যান্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নারীকর্মীরা দেহ ব্যবসা চালাচ্ছেন। দেশ থেকে মেয়ে এনে অথবা এ দেশে থাকা অবৈধ মেয়েদের দিয়ে অনৈতিক কাজের জন্য ছোট ছোট রুম ভাড়া নিয়ে পতিতালয় তৈরি করছেন। দেহ ব্যবসার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এখানে বিভিন্ন অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী ভিসায় লেবাননে আসা নারীকর্মীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। লেবাননে কতিপয় দালালদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট এবং এ সিন্ডিকেটের সদস্যরাই গৃহকর্মী ভিসায় লেবাননে আসা নারী কর্মীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে অথবা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের লোভ-লালসা দেখিয়ে তাদের মালিকের কর্মস্থল থেকে ভাগিয়ে আনছেন।

পশ্চিম এশিয়ার লেবানন হচ্ছে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মিলনস্থল। পাহাড় ও সাগর বেষ্টিত লেবাননে বহিরাগতরাই দেশটির চালিকাশক্তি। এক সময় ফরাসি উপনিবেশ লেবাননকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বা প্যারিস। সেই লেবাননে কাজ করতে এসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভাগ্য বদলের পাশাপাশি নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন।

লেবাননের স্থানীয় থানাগুলোতে লেবানিজদের দায়েরকৃত এমন হাজার হাজার অভিযোগ রয়েছে। সেই কারণে এখানকার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বাংলাদেশ থেকে নারীকর্মী আনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।

২০১৮ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে শাহীনা বেগম নামে এক নারী খুন হন। তাকে খুন করার অপরাধে চার বাংলাদেশি নারীকর্মী বর্তমানে লেবাননে কারাবন্দি রয়েছেন। গত ১১ নভেম্বর সকাল নয়টার দিকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের হাজমিয়ে এলাকায় পরকীয়ার জেরে স্বামীকে হত্যার উদ্দেশ্যে গলায় ছুরি চালান বাংলাদেশি এক নারী। পরে নিজের গলায়ও ছুরি চালান তিনি।

গত ২ এপ্রিল রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টায় বৈরুতের আলবস্তা নামক এলাকায় পরকীয়ার জেরে একপর্যায়ে স্বামী তার স্ত্রীর গলায় ছুরি চালান। ঘটনাস্থলেই মারা যান স্ত্রী। এসব অপরাধের কারণে লেবাননে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

শুধু তাই নয়, দেহ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখানকার বাংলাদেশিরা যেমন বিপদগামী হচ্ছেন, অন্যদিকে অবৈধ সম্পর্কের কারণে অনেক প্রবাসীর পরিবারেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর মতো লেবাননেও চলে লিভ টুগেদার। এখানে নারী পুরুষ একই ঘরে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাস করেন অনায়াসে। ফলে সামাজিক অবক্ষয়ের আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্টজনেরা। বর্তমানে বাংলাদেশিদের প্রতি লেবানন সরকারের একধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। ফলে মাসুল দিতে হচ্ছে সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশিদের।

বর্তমানে বাংলাদেশিদের আকামার ক্ষেত্রে সামান্য কোনো সমস্যা পেলেই পুলিশ ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

এটি একটি বড় সমস্যা বলে মনে করেন অনেক প্রবাসী। অনেক আগে থেকেই এখানে লিভ টুগেদার চললেও বিগত কয়েক বছর ধরে দেহ ব্যবসা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে নারীকর্মীরা শুধু বাংলাদেশিদের সঙ্গেই নয়, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, মিশরি, সুদানি, সিরিয়ানসহ অন্যান্য দেশের পুরুষদের সঙ্গেও অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলছেন।

সর্বশেষ ২৩ ফেব্রুয়ারি লেবাননের টিভি চ্যানেল ‘ওটিভি’ তে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়। সেটি কয়েকদিনের মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, লেবাননের বুরুজ হাম্মুদ এলাকায় শাহনাজ নামে এক বাংলাদেশির রুমে এক লেবানিজ খদ্দের সেজে প্রবেশ করে এবং গোপন ক্যামেরা দিয়ে সম্পূর্ণ কথোপকথন ভিডিও করে মিডিয়ায় প্রচার করে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, শাহনাজ নামের ওই বাংলাদেশি একটি রুম ভাড়া নিয়ে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি নারীকে সঙ্গে নিয়ে দিনের বেলায় এসব অবৈধ কাজ পরিচালনা করতেন। শাহনাজ ১০ বছর আগে লেবাননে আসেন এবং তিনি ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলে জানা গেছে। ওইদিন রাতেই পুলিশ ওই রুমে হানা দিয়ে তাসলিমা নামে অন্য এক নারীকে আটক করে। তবে মূল হোতা শাহনাজ পালিয়ে যান।

এ বিষয়ে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার জানান, দূতাবাসের জনবল সংকট থাকায় এ বিষয়ে কিছুই করতে পারছি না। অপরদিকে দূতাবাস যদি এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, তাহলে এখানকার স্থানীয় মিডিয়াতে ব্যাপারটি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ও থাকে। বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে বলে আমরা কিছুই করতে পারছি না।

‘বিদেশে প্রবাসীদের এসব কর্মকাণ্ড দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে’- বলেও স্বীকার করেন তিনি।

‘প্রবাসীদের এমন অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখতে দূতাবাসের পক্ষ থেকে কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তাদেরকে (প্রবাসীদের) দেশের সম্মান ক্ষুণ্ন না করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে’- বলেন আব্দুল মোতালেব সরকার।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় দেড় লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। অনেকে দুর্গম এলাকায় কাজ করেন। ফলে সবার কাছে পৌঁছানো দূতাবাসের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া এত বড় দায়িত্ব কেবল দূতাবাসের একার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। তাই আমি লেবাননে বসবাসকারী সব প্রবাসীকে এ কাজে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানাচ্ছি এবং সবাইকে এসব অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।’

এমআরএম/জেআইএম

আরও পড়ুন