বিদেশে এসে বুঝলাম জীবনের মানে কী?
আমি একজন প্রবাসী। প্রবাস কথাটা শুনলেই কলিজার পাশ কাটিয়ে একটা দাগ কেটে যায়। যখন দেশে ছিলাম তখন আমার বাবা ছিলেন একজন প্রবাসী। বাবার কাছে কত চাহিদা ছিল, সব চাহিদা বাবা হাসিমুখে পূরণ করতেন। তাই আমিও ভেবে নিয়েছিলাম প্রবাসে মনে হয় অনেক সুখ আর টাকা বাতাসে ওড়ে।
তাই বাতাসের উড়ন্ত টাকা ধরতে চলে এলাম প্রবাসে; আর আমার নাম হয়ে গেল প্রবাসী। প্রবাসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গিয়েছিলাম জীবন কী জিনিস। যেদিন এসেছিলাম তার পরদিন থেকেই কাজ শুরু করেছিলাম।
প্রবাসী হলো চোখ বন্ধ করে কষ্ট সহ্য করার একটি ক্ষেত্র। দিনভর কাজ করে রান্না করার বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন যার সঙ্গী, সেনাবাহিনীর মতো নিয়মমাফিক জীবন-যাপন যার নিত্য কর্ম, শত বঞ্চনায় যার মুখে থাকে আপনজনকে সুখে রাখার এক চিলতে মিছে হাসি। সেই তো প্রবাসী। ধু ধু মরুর বুকে নিরলস কাজ করেও প্রবাসীরা থেমে থাকে না।
প্রবাসী কাজ করবে খরা রৌদ্রের, প্রচণ্ড শীতে ১০ ঘণ্টা, ১২ ঘণ্টা এমনকি ১৪ ঘণ্টাও। এর চেয়েও বেশি। নিয়মের বাইরে যাওয়ার তার সুযোগ নেই। মায়ের মৃত্যুতেও সে দেশে যেতে পারবে না চাইলেও, কারণ সুনির্দিষ্ট একটি বিধিতে মিলবে ছুটি। প্রবাসী মরলেও তার লাশ নিয়ে কত বিড়ম্বনা। কত আনুষ্ঠানিকতার পর সেটা দেশে যাবে। জীবনের সিংহভাগ কাটিয়ে অনেক প্রবাসীর শেষ নিঃশ্বাসটা যায় প্রবাসে, থাকে না কোনো আপনজন।
শত মান অভিমান বুকে ধারণ করেই পৃথিবীকে বিদায় জানায় অনেকটা নিঃসঙ্গভাবেই। যে মানুষগুলোর জন্য এত আয়োজন, এত শ্রম, ত্যাগ আর ভালোবাসা সেই প্রিয় মানুষগুলো এই অন্তিম মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে পারে না। না ইচ্ছা করে নয়, বাস্তবতার কারণেই আপনজনকে কাঁদতে হয় হাজার মাইল দূরে বসে। বাবা কাঁদে, কাঁদে গর্ভধারিণী মা। ভাই বোন ও আত্মীয়-স্বজন কিন্তু এখন সেই কান্না তো আর পৌঁছায় না।
‘বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, বড় ইচ্ছা হয় ফোন রিসিভ করব কিন্তু আমিতো কাজেই আছি, ধরব কিভাবে, সাইটে কাজ করছি, বস জানতে পারলেই চাকরি শেষ। আমি অসুস্থ, ইচ্ছা হয় না কাজে যেতে একদিন, এত মাথা ব্যথা নিয়ে কীভাবে যায়, কিন্তু হঠাৎ অফিস থেকে আসল কল, যেতে হবেই, নইলে কাটবে বেতন। এ রকম অসংখ্য জরুরি মুহূর্তেও প্রবাসীকে নিয়তি মেনে নিতে হয়।’
‘এই মেনে নেয়ায় যেন তার ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর আমরা প্রবাসী সুখ বিলিয়ে দিই, কষ্ট সহ্য করেও হাসি ফোটাই। শত শত বেদনার কাহিনি আমাদেরকে দাবাতে পারে না। কাজ শেষে রুমে এসে আমরা বিভিন্ন বিনোদনমূলক কাজের কষ্টগুলো ভুলে যায়। ফাঁকে ফাঁকে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো আমাদের কাছে নিয়ে আসে দেশীয় আবেগ।’
অতিথি লেখক/ মুহাম্মদ আবদুস শাকুর, শারজা, আরব আমিরাত
এমআরএম/এমএস