কবে ভোট দিতে পারবেন কোটি প্রবাসী
বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অসন্ন। ভোটাধিকারের সুযোগ দিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও প্রবাসীদের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হলেও আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সেই সুযোগ পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন সম্ভব হলেও পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার কাজও বন্ধ রয়েছে। ফলে থমকে গেছে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ।
বিশ্বের ১৬০টি দেশে অবস্থানরত প্রায় এক কোটি যোগ্য নাগরিককে ভোটাধিকারের বাইরে রেখেই একাদশ জাতীয় নির্বাচন হতে চলেছে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি ‘গোল্ডেন বয়’ হিসেবে পরিচিত এই প্রবাসীদের নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে থাকতে হচ্ছে। এ নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করলেও সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) যেন এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
প্রবাসীদের অভিযোগ, প্রবাসীরা যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেজন্য আইন সংশোধন করা হয়েছে ৮ বছর আগে। এরমধ্যে দুটি জাতীয় নির্বাচন ও বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো নির্বাচনেই তারা ভোট দিতে পারেননি।
তবে ইসি সংশ্লিষ্টরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, বিশ্বের এতগুলো দেশ ঘুরে ইসির পক্ষে তাদের ভোটার করা খুবই জটিল কাজ। কমিশনের নিজস্ব জনবল এত নেই। এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু তারা তা করছে না। তাই কাজটি (প্রবাসীদের ভোটের আওতায় আনা) করা সম্ভব হচ্ছে না।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, বিপুলসংখ্যক প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে নির্বাচন বিধিমালায় সংশোধনী আনে নির্বাচন কমিশন। সংসদে আইন পাস হয়। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বরে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের আইনে সম্মতি দিয়ে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। ওই আইনে বলা আছে, ‘কোনো বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে বসবাস করলে তিনি দেশে সর্বশেষ যে নির্বাচনী এলাকা বা ভোটার এলাকায় বসবাস করেছেন অথবা তার নিজের বা পৈত্রিক বসতবাড়ি যেখানে ছিল বা রয়েছে; তিনি সেই এলাকার অধিবাসী বলে গণ্য হবেন।’
সে সময় ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এখন থেকে সকল নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন প্রবাসীরা। প্রবাসীরাও আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু এরপর ৮ বছর কেটে গেলেও আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ইসির সর্বশেষ ভোটার তালিকায় ১০ কোটির বেশি ভোটার রয়েছে। আর প্রবাসে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় এক কোটির কাছাকাছি। যদিও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নন সবাই।
সূত্র জানায়, বর্তমান ইসি রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে যে সংলাপের আয়োজন করেছে, তাতে এ পর্যন্ত অংশ নেয়া রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা প্রবাসীদের ভোটাধিকার বিষয়টি আবারও সামনে নিয়ে আসেন। অবশ্য এর আগে পরিকল্পনা পর্যায়ে ইসির কাছে প্রস্তাব এসেছিল, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে কমিশন ভোটার আবেদন ফরম পাঠাবে। দূতাবাস থেকে সে দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ফরম সংগ্রহ করে তা পূরণ করে আবার দূতাবাসেই জমা দেবে। এরপর দূতাবাস বাংলাদেশে তাদের স্থায়ী ঠিকানা অনুযায়ী জেলাভিত্তিক প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করে পাঠাবে ইসির কাছে। ইসি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার মাধ্যমে তা যাচাই-বাছাই করবে। কিন্তু তা আর হয়নি।
নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন সংশোধন হলেও প্রয়োজনীয় বিধিমালা করার কাজটি এখনও এগোয়নি। তবে প্রবাসীদের কীভাবে ভোটার করা হবে তা নিয়ে ভাবা উচিত। তারা বলেন, ‘কয়েকটি দেশের দূতাবাসে পাসপোর্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু একই কায়দায় জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া কঠিন।’
তাদের মতে, ভোটারদের তথ্য যাচাইয়ের জন্য সব ডাটা দেশে এনে তথ্যভাণ্ডারে যাচাই করতে হবে। তারপর ভোট দেয়ার প্রসঙ্গ আসবে। তবে ৩০০ আসনের ব্যালট পেপার, প্রয়োজনীয় ব্যালট বাক্সসহ নানা কারিগরি ও সামগ্রী প্রতিটি দেশে সরবরাহ প্রায় অসম্ভব।
এ বিষয়ে বাংলাদেশি স্কলার ইউনিভার্সিটি তেনাগা ন্যাশনাল মালয়েশিয়ার প্রফেসর ড. নওশাদ আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি এই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স জাতীয় প্রবৃদ্ধির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অবদান রেখে চলেছে। নাগরিক হিসেবে এই প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখলেও তাদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক অধিকার ‘ভোটাধিকার’ প্রয়োগ করতে পারছেন না বছরে পর বছর।’
তিনি মনে করে, বিশ্বজুড়ে বসবাসরত লাখ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটদানের সুযোগ ছাড়া বাংলাদেশে যেকোনো জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও কোনভাবেই অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
একটি উদাহরণ দিয়ে নওশাদ আমিন বলেন, ‘মালয়েশিয়ার নাগরিক বসবাস করেন কানাডায়। ওই মালয়েশিয়ান নাগরিক যদি কানাডায় থেকে তার দেশের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন, তাহলে রেমিট্যান্সের উৎস তথা প্রবাসী বাংলাদেশিদের তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার তথা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা নিঃসন্দেহে অসাংবিধানিক।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ‘অ্যাবসেন্টি ব্যালট সিস্টেম’ চালু আছে। যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই ভোট দিতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরা যদি ভোট না দেন সেক্ষেত্রে তাদের জরিমানা করার ব্যবস্থা আছে। প্রবাসী জাপানি নাগরিকরাও ভোট দিতে পারেন।
কানাডার নাগরিকরা যারা স্বল্পকালীন অথবা দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য কানাডার বাইরে আছেন তাদের জন্য রয়েছে মেইলিং পোলিং সিসটেম। আর যারা ভোটাদানের নির্ধারিত তারিখের আগেই কানাডা ছাড়বেন, তাদের জন্য রয়েছে অ্যাডভান্স পোলিং সিসটেম।
বিশ্বের অন্যতম রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশ ফিলিপাইনও তার প্রবাসী নাগরিকদের জন্য ভোটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। হংকং, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরেও আছে অপটিক্যাল স্ক্যানিং ভোটিং সিস্টেম।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. আবদুল কুদ্দুছ বলেন, ‘সদিচ্ছা এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রবাসীদের এই অধিকার পূরণ খুব কঠিন কিছু নয়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে দ্রুততম সময়েই প্রবাসী ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব। একই সঙ্গে প্রবাসীরা নিজ দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস, হাইকমিশন ও কনস্যুলেট অফিসের মাধ্যমে সহজেই ভোট প্রদান করতে পারবেন।’
মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মহা. শহীদুল ইসলাম সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের চিত্র তুলে ধরে জানান, প্রবাসীদের এনআইডির (জাতীয় পরিচয়পত্র) প্রয়োজন প্রতিটি ক্ষেত্রে। ইসি উদ্যোগ নিলে দূতাবাস সব ধরনের সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, এনআইডি দেয়াও ভীষণ রকমের কঠিন কাজ। প্রবাসী অনেকেই দেশে এসে এনআইডি করেছে; কিন্তু যাদের নেই তাদের মধ্যে এমআরপিধারীদের অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আরও আলোচনার তাগিদ দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে দেশের উচ্চ আদালত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার সংবিধান স্বীকৃত বলে রায় দেন। কিন্তু দীর্ঘ ২০ বছরেও সেই রায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের লক্ষ্যে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই তাদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেসময় নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও এম সাখাওয়াত হোসেন এবং কমিশন সচিবালয়ের একজন সিনিয়র সহকারী সচিব মো. হারুনর রশীদ এ লক্ষ্যে ব্রিটেন সফর করেন। দেশে ফিরে নির্বাচন কমিশনাররা জানান, ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার করা হবে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে। দূতাবাসগুলোতে এ বিষয়ে বিশেষ ডেস্ক স্থাপন করা হবে। কিন্তু ওইসময় প্রণীত ভোটার তালিকা অধ্যাদেশে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব স্থান পায়নি।
এসআর/পিআর