অথৈ সাগরে আল্লাহই ছিল ভরসা
‘রাত তখন প্রায় ৩টা। অতিরিক্ত যাত্রীসহ আমাদের স্পিডবোটটি ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। সবার গন্তব্য ইউরোপ। সাগরের উত্তাল গর্জন আর স্পিডবোটের গার্ডদের চোখ রাঙানি সব মিলিয়ে নৌপথটি আমার কাছে একটি বিভীষিকাময় রাত ছিল।’
এভাবেই বলছিলেন সদ্য গ্রিসে যাওয়া সাগর। বলেন, ‘স্পিডবোটটি যখন মধ্য সাগরে অবস্থান করছিল তখন ঝড়ের কবলে পড়ে। প্রচণ্ড ঝড়ে বার বার সাগরের পানির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আবার কখনও সাগরের ঢেউয়ে আঁছড়ে পড়ছে। আমরা সবাই কালেমা পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছিলাম।'
‘এর কিছুক্ষণ পর ঝড় থামলে আমাদের বোটটি বর্ডার গার্ডের হাতে ধরা পড়ে। আমিসহ সবাই লিবিয়ার কারাগারে বন্দি জীবন-যাপন করি প্রায় ছয় মাস। ভাগ্য বদলের আশায় এভাবেই অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে শত শত বাংলাদেশি।’
আফ্রিকা ও আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্ক কিংবা গ্রিসে নৌপথে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর কিংবা আটলান্টিক মহাসাগর স্পিডবোট কিংবা ট্রলার দিয়ে পাড়ি জমানোর সময় সলিল সমাধি হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। আবার আফ্রিকার দেশ মরোতানিয়া রটে সাহারা মরুভূমি হয়ে পর্তুগাল ঢোকার চেষ্টাকালে সাহারা মরুভূমির দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনাহারে অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
এর মধ্যে আবার কেউ কেউ অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকালে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। আবার দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকে জিম্মি জীবন যাপন করছেন। মুক্তির জন্য দেশ থেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা-পয়সা দিয়েও মিলছে না তাদের মুক্তি।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় লিবিয়ার কারাগারে ২৮০ জন বাংলাদেশি নাগরিক বন্দি রয়েছেন।
ইউরোপের অন্যতম প্রবেশপথ স্পেন সফর করে করে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে স্পেনে যারা এসেছেন তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বর্তমানে মানব পাচারকারী দালাল চক্ররা এখন ইউরোপে ঢোকার জন্য যুদ্ধবিধস্ত লিবিয়াকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। দালালদের মাধ্যমে আসা বেশিরভাগ বাংলাদেশি চেষ্টা করেন লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে ইউরোপের দেশ গ্রিস কিংবা ইতালিতে অনুপ্রবেশের।
দালালদের মাধ্যমে স্পেনে আসা এক বাংলাদেশি জানান, তিনি যে স্পিডবোট দিয়ে লিবিয়া থেকে তুরস্ক এসেছিলেন সেই স্পিডবোটের ১৯ জন যাত্রীর মধ্যে দুজন বোটে মারা যান। তাদের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ ও কানাইঘাটে।
তিনি বলেন, ‘ভূমধ্যসাগরে লিবিয়া থেকে যখন স্পিডবোটটি যাত্রা শুরু করে তখন রাতের আধারে তুরস্ক পৌঁছানোর চেষ্টা থাকে। তাই স্পিডে চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের বোটটি তুরস্কের কাছাকাছি আসতে আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দেখে আচমকা গতি থামায়। ফলে প্রায় ৪ ঘণ্টা প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকে। একটা সময় আমাদের মধ্যে দুই যাত্রীর মৃত্যু হয়।
সবচেয়ে কষ্টদায়ক ছিল বাংলাদেশি মৃত দু’জনের মরদেহ দালালরা ভূমধ্যসাগরে নিক্ষেপের দৃশ্য দেখে। আমরা এর প্রতিবাদ করলে দালালরা জানায়, বেশি চেচামেচি করলে সবাইকে জেল খাটতে হবে। তাই আর কেউ প্রতিবাদ করেনি।
ইউরোপে ঢোকার আরেক পথ হলো আলজেরিয়া থেকে মরোতানিয়া হয়ে সাহারা মরুভুমি পর মরক্কো হয়ে পর্তুগাল। এই রুটের সবচেয়ে ভয়ানক পথ হলো সাহারা মরভূমি। এই সাহারা মরুভূমি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। সাহারা মরুভূমি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যায়।
এক সপ্তাহের পায়ে হাঁটার পথে পানাহারের জন্য দু‘বোতল তরল পানি ছাড়া আর কিছু বহন করতে দালাল চক্র নিরাপদ মনে করে না। দালালরা যাত্রীদের তাড়াতাড়ি পথ পাড়ি দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। সাহারা মরুভূমিতে যখন যাত্রীরা পথ পাড়ি দিতে রওয়ানা হন তখন তাদের অনুসরণ করতে থাকে অন্য দালাল সদস্যরা।
আইন-শৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলতে থাকে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার প্রয়াস। অনেক সময় এই পথ এক সপ্তাতে শেষ হয় আবার পথে ঝামেলা হলে বিলম্ব হয়। যাত্রাপথে পানি শেষ হলে শুরু হয় যাত্রীদের আর্তনাদ। প্রচণ্ড গরমে হাহাকার করতে করতে অনেকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। এরপর শুরু হয় দিন গোনা কবে ঢুকতে পারবেন পর্তুগাল কিংবা স্পেনে।
এদিকে, দালালদের মাধ্যমে যারা ইউরোপে ঢুকতে পেরেছেন তাদের মাথা গোজার জন্য জীবন যুদ্ধে নামতে হয়। প্রথমে তাদের বাসস্থানের জন্য পরিচিত জনদের কাছে যেতে হয়। বাসস্থানের পর কাজের জন্য মিথ্যা চেষ্টা করতে হচ্ছে। ইউরোপের যে কোন দেশে যেমন স্পেন, ফ্রান্স ইতালি কিংবা পর্তুগালে কাজের পারমিট ছাড়া কাজ পাওয়া সম্ভব নয়।
যারা অ্যাসাইলাম কিংবা হিউম্যান রাইটসে থাকার জন্য আবেদন করেন তাদের আবেদন বিবেচনা কিংবা আমলে নিতে প্রায় ৮ মাস সময় লেগে যায়। কোন কোন দেশে কোন ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগে। এভাবেই কাটতে থাকে প্রবাসীদের জ্বালাময় জীবন।
এমআরএম/জেআইএম