মালয়েশিয়ায় জিটুজির শ্রমিকদের করুণ দশা
এক শ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সির ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়েছে মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর বর্তমান পদ্ধতি ‘জিটুজি’ (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট)। কম খরচে ও অপেক্ষাকৃত বেশি বেতনে কর্মী পাঠানোর সরকারের এ উদ্যোগ ব্যর্থ করতে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে কতিপয় আদম ব্যবসায়ী।
মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীদের ম্যানেজ করে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ে দেশের সরকারের নীতি-নির্ধারকদের পাশ কাঠিয়ে কর্মী পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। এতে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন নিরীহ সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে জিটুজি পদ্ধতিতে প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মী পাঠানোর স্বাভাবিক গতি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে ও জিটুজি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় আসা নতুন কর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে এসব তথ্য।
আদম ব্যবসায়ীদের এই অপতৎপরতা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলে আবারও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার জসিম উদ্দিন, আমিনুল ইসলাম, মো. বশির মিয়া। কুমিল্লার ফারুক, নাসু মিয়া, শামীম, সজীব, তোতা মিয়া, ফয়সল সুমন। ভোলার আজাদ, শরিফ, জাকির, আব্দুস সাওার। পাবনার আইনুল। যশোরের তবিকুর, ফারুক। চাঁদপুরের মমিন মিয়া, চুয়াডাঙ্গার আব্দুর রহিম, হাবিবুর সুহেল, নাসিম। বাগেরহাটের জাহাঙ্গীর, নোয়াখালীর নাসির চট্টগ্রামের হেফাজ উদ্দিন,কিশোর গন্জের শফিকুল ইসলামসহ প্রায় ৩৯ জন শ্রমিক একটু সুখের আসায় প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়ে এসেছে মালয়েশিয়ায়। এখন তাদের চোখের পানি থামছে না। মালয়েশিয়া আসার পরপরই গত ৫ মাস ধরে তাদের কাজ নেই, নেই বেতন। মালিক পক্ষের অমানবিক আচরণ এবং অনাহারে তাদের শরীর র্দুবল হয়ে গেছে। এক ধরনের বন্দী জীবন যাপন থেকে মুক্তি পেতে ৩৯ জনের মধ্যে ২৮ জন গত ১২ এপ্রিল রাতের আঁধারে পালিয়ে আশ্রয় নেন কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসে। তারা কুয়ালালামপুর থেকে ৩শ কিলোমিটার দূরে মেলাক্কা শহরের জালান টেক, তামান আয়ের কেরাহ হাইট এলাকার মোহামেদ রেশা ও বেরাকাত এসডি এন বিএইচডি নামে তিন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বৃহস্পতিবার দূতাবাসে তাদের সঙ্গে কথা হয়। এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তারা জানান, জনশক্তি রফতানিকারক আল ইসলামকে জন প্রতি সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া এসেছেন। থাকা খাওয়া দূরে থাক, ৫ মাস ধরে কোনো কাজ নেই। বাড়িতে তারা কোনো টাকা পাঠাতে পারেন না। এ দিকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার জসিম উদ্দিনের বাবা আরু মিয়া ঢাকায় জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরো অফিসে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) মুহাম্মদ আতাউর রহমান এই ৩৯ জন কর্মীর ৫ মাসের বেতন ভাতা না দেয়ার কারণ জানাতে ও তাদের কাজের ব্যবস্থা করার জন্য দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলরের কাছে লিখিত নোটিশ পাঠিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দেশে তৈরি জনশক্তি রফতানিকারক ১০ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট তাদের মতো এক লাখের বেশি কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু তারাই নয়, হাজার হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় নির্মম জীবন যাপন করছেন।
প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেট প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ দূতাবাসকেও জিম্মি করে ফেলেছে। দশটি রিক্রুটিং এজেন্সির সমন্বয় গঠন করা হয়েছে এই সিন্ডিকেট। এর বাইরে কেউ মালয়েশিয়া শ্রমিক পাঠাতে পারবে না। এখন সিন্ডিকেটে যা বলে তাই আইন। একে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা কারও নেই। জি টু জি প্লাস প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়ার সরকার-নির্ধারিত খরচ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে প্রতিজনের এ জন্য খরচ হচ্ছে সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। র্অথাৎ, একজন শ্রমিককে মালয়েশিয়া যেতে নির্ধারিত খরচের ১০ থেকে ১৫ গুণ টাকা গুনতে হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, খরচের বিষয়ে তাদের মুখ খুলতে বারণ করে দেয়া হয়েছে। মুখ খুললে তাকে আর মালয়েশিয়া পাঠানো হবে না। এমন কি জমাকৃত টাকাও ফেরত দেয়া হবে না। নানা কারণেই কর্মীরা ৪০ হাজার টাকার কথাই সব জায়গায় বলে যায়। বাড়তি ৫ লাখ টাকা আড়াল হয়ে যায়। সিন্ডিকেটের এমন ভয়ে দেশের লাখ লাখ তরুণ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
ভূক্তভোগি অনেকেই হতাশার সুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, তারা খুব শক্তিশালী। সিন্ডিকেট যা করছে তা কোনো মানুষের কাজ না। দানবেও এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে না। দেশের গরিব মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কর্মীরা সেখানে খেয়ে পড়ে এক পয়সাও বাড়িতে পাঠাতে পারে না। যে চাকরির কথা বলে তাদের মালয়েশিয়া পাঠানো হয়েছে তার ধারে কাছেও কেউ চাকরি পায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী বলেন আপনাদের হাতে কলম আছে-আপনারা এই ভয়ঙ্কর জালিয়াতির বিরুদ্ধে লেখেন। দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হবে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হবে না।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে সচিব ড. নমিতা হালদার বলেন, ‘আমরা এমন অনেক কেস ডিল’ করছি। জনশক্তি রফতানিকারক ও অভিযোগকারী কর্মীকে মুখোমুখি করার পর দেখা গেছে তারা যে সাড়ে চার লাখ বা সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন তা স্বীকার করছেন না। তারা সরকারের বেঁধে দেয়া খরচের কথাই বলছে। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকে না। আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি ওই কর্মী অনেক বেশি টাকা জনশক্তি রফতানিকারকদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ২০১৩ সালের আইনে যা বলা আছে তাতে আমরা অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না’।
১০টি এজেন্সি নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেট সর্ম্পকে সচিব বলেন, এই সিন্ডিকেট আমরা করিনি। হয়েছে মালয়েশিয়া থেকেই। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে ৯শ এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তারা নিজেরা ১০টি এজেন্সিকে বাছাই করে ৫ লাখ কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে।
সিন্ডিকেটের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে প্রান্তিক ট্রাভেল, ইউনিক ইস্টার্ন, ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যারিয়ার ওভারসিজ, আমিন অ্যান্ড ট্যুরস, এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, প্যাজেস অ্যাসোসিয়েটস ও আল ইসলাম ওভারসিজ।
বায়রার বর্তমান ও সাবেক কমিটির অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এই ১০ প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত এক লাখ ১০ হাজার শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। বাকি আরও তিন লাখ ৯০ হাজার জন পাঠানোর জন্য তারা প্রায় ১৫ লাখ লোকের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের মেডিক্যাল করার জন্য ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে।
এদিকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী ও শ্রমিকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনিভাবে বাড়ছে নানা সঙ্কট ও সম্ভাবনাও। খুব শিগগিরই এসব সমস্যা নিরসন করে সম্ভাবনাগুলো কাজে না লাগালে মালয়েশিয়ার এই বৃহৎ শ্রমবাজারে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না।
এমএমজেড/এমএস