বিএনপি পুনর্গঠনে অতিমূল্যায়ন আর অবমূল্যায়নের অভিযোগ
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চলমান পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদে রদবদলে অতিমূল্যায়ন আর অবমূল্যায়নের অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, দু-চারজন নেতার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতরাই পদোন্নতি পাচ্ছেন। কার্যত শূন্য দিয়ে বিএনপির শূন্য পূরণ চলছে। পুনর্গঠনের নামে নোংরা খেলা (ডার্টি গেম) হচ্ছে। তবে দলের ভেতরেই অনেকে ভিন্ন মত পোষণ করছেন। তারা বলছেন, চলমান পুনর্গঠনের ফলে দল শক্তিশালী ও গতিশীল হবে। সেইসঙ্গে আগামী আন্দোলনে তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান জাগো নিউজকে বলেন, দলের চলমান পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল ,আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামালদের যারা অনুসারী রয়েছেন তাদের পদোন্নতি হয়েছে। এর বাইরে কারও পদোন্নতির সুযোগ হচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের বৈদেশিক উপদেষ্টা কমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে আব্দুল মঈন খানের দীর্ঘদিনের যে নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সেখানে মঈন খানের জয় হয়েছে।
তবে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে দলের নেতাদের পদোন্নতি হচ্ছে এমন বক্তব্য মানতে নারাজ রুহুল কবির রিজভী।
জাগো নিউজের এক প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, দলে যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, যাদের পদাবনতি হয়েছে সবাই আমার ঘনিষ্ঠ। সবাইতো বিএনপির। কেউ তো আর আওয়ামী লীগ বা অন্য দল করে না। দলের সবাই আমার ঘনিষ্ঠ।
তিনি বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী দলের পুনর্গঠন হচ্ছে। যাদের পদোন্নতি হয়েছে তারা সকলেই আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন।
বৈদেশিক সম্পর্কে দলের মধ্যে যথার্থ যোগ্য আস্থাভাজন নেতার অভাব থাকায় তারেক রহমান এই কমিটির প্রধান হয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে বিএনপি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দায়িত্ব তারেক রহমান নিজ হাতে নিয়েছেন এটা খুবই ভালো দিক। আগামীতে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলের মিত্রহীন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল। আমলা রাজনীতিবিদ কূটনীতিকদের সমন্বয়ে এই কমিটি নিয়ে আশা রাখা যায়। তবে হুমায়ুন কবির এবং তাজভিরুল ইসলামের এই ফোরামে উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত।—বিএনপির সাবেক এক সংসদ সদস্য
গত ১৫ জুন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর চার দফা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে রদবদলের মাধ্যমে ৭৫ জন নেতার পদ পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে রয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৪৫ জন, মিডিয়া সেলে একজন, চেয়ারপারসনের বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিতে ১১ জন এবং চেয়ারপারসনের বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির বিশেষ সহকারী ১৮ জন। এরমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদারে এবার মাঠে তারেক রহমান
১১ সদস্য বিশিষ্ট চেয়ারপারসন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি গঠন হয়েছে। পদাধিকার বলে তারেক রহমান এই কমিটির প্রধান। সদস্য হিসেবে এই কমিটির তালিকায় দ্বিতীয় নাম রয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খানের। ক্রমান্বয়ে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আব্দুল আওয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল হোসেন জবিউল্লাহ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম এবং কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি সভাপতি তাজভিরুল ইসলাম।
আরও পড়ুন:
বিএনপির হয়ে কূটনীতিতে কাজ করা সাবেক এক সংসদ সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, বৈদেশিক সম্পর্কে দলের মধ্যে যথার্থ যোগ্য আস্থাভাজন নেতার অভাব থাকায় তারেক রহমান এই কমিটির প্রধান হয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে বিএনপি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দায়িত্ব তারেক রহমান নিজ হাতে নিয়েছেন এটা খুবই ভালো দিক। আগামীতে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলের মিত্রহীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল। আমলা রাজনীতিবিদ কূটনীতিকদের সমন্বয়ে এই কমিটি নিয়ে আশা রাখা যায়। তবে হুমায়ুন কবির এবং তাজভিরুল ইসলামের এই ফোরামে উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আব্দুল মঈন খান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মধ্যে নেতৃত্বের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। সেটার প্রতিফলন বিএনপি চেয়ারপারসনের বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি গঠনে রয়েছে। সে কারণে কমিটির দ্বিতীয় নম্বরে স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খানের নাম এবং বিএনপির বিদেশ বিষয়ক কমিটির প্রধান হিসেবে ব্যর্থ হওয়ায় শাস্তিস্বরূপ এই কমিটির চার নম্বর তালিকায় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নাম রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মঈন খান চেষ্টা চালাচ্ছিলেন চেয়ারপারসনের পরে তালিকার দ্বিতীয় নামটা তার রাখার জন্য। এই কমিটির মাধ্যমে মঈন খানের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হলো।
তিনি বলেন, মঈন খান এবং আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যদি ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নেয় তাহলে এ কমিটি বিএনপির কোনো কাজে আসবে না।
জাইমা রহমানকে নেতৃত্বে আনার প্রস্তুতি
১৮ সদস্য বিশিষ্ট স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজারি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১২ জন দলের সিনিয়র নেতাদের সন্তান। এই কমিটির প্রধান বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদ শামা ওবায়েদ। এই তালিকার দ্বিতীয় নামটি রয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য প্রয়াত এম তরিকুল ইসলামের ছেলে সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। কমিটির অন্যদের মধ্যে নাসির উদ্দিন অসীমের শ্বশুর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান, স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকারের সন্তান নওশাদ জমির, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য হারুনুর রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে আফরোজা খান রীতা, সাবেক মন্ত্রী আখতার উদ্দিন আহমেদ খানের মেয়ে জিবা খান, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ এবং ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীর মেয়ে নিপুণ রায় চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মীর নাসিরের ছেলে মীর হেলাল, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন, উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন পুতুল, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে ইসরাফিল খসরু।
বাকি ছয়জনের মধ্যে কায়সার কামাল, আসাদুজ্জামান, রবিউল ইসলাম এবং ফাহিমা নাসরিন মুন্নি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হয়ে দলে কাজ করছেন। আবু সালেহ মো. সায়েম (ইউকে) বাংলাদেশে থাককালে জামায়াত-শিবির এবং মো. ইকবাল হোসেন বাবু (বেলজিয়াম) জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। এরা এখন বিদেশ গিয়ে বিএনপি নেতা সেজেছেন।
আরও পড়ুন:
বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সাবেক এক সংসদ সদস্য বলেন, নবগঠিত বৈদেশিক কমিটিকে সহায়তার জন্য ১৮ সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তার দিকে তাকালে মনে হয় দলীয় পদকে ঈদের পোশাক হিসেবে উপহার দেওয়া হয়েছে। যারা এখানে রয়েছেন দলের সবারই তো একাধিক পদ রয়েছে। তারপরও তারা আবার কেন?
একজন যুগ্ম মহাসচিবের ভাষ্য, স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি দেখে মনে হয় আগামীতে তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমান দলের দায়িত্ব নেবেন, তার জন্য অগ্রিম টিম গঠন করা হয়েছে।
দলে যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, যাদের পদাবনতি হয়েছে সবাই আমার ঘনিষ্ঠ। সবাইতো বিএনপির। কেউ তো আর আওয়ামী লীগ বা অন্য দল করে না। দলের সবাই আমার ঘনিষ্ঠ। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী দলের পুনর্গঠন হচ্ছে। যাদের পদোন্নতি হয়েছে তারা সকলেই আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন।—রুহুল কবির রিজভী
কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন পদায়িত নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান একজন, উপদেষ্টা পরিষদের ১১ জন, যুগ্ম মহাসচিব ৩ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক ৪ জন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ৬ জন, সম্পাদক ৩ জন, সহ-সম্পাদকীয় পদে ৩ জন, সহ-সম্পাদকীয় পর্যায়ে থেকে পদাবনতিতে সদস্য পদে ৫ জন, নতুন সদস্য ৫ জন এবং প্রবাস থেকে সদস্য ৪ জন সর্বমোট ৪৫ জন এদের মধ্যে বিভিন্ন পদে নতুন মুখ অন্তত ১০ জন রয়েছে।
একজন ভাইস চেয়ারম্যান
বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপনের দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে পদায়ন যথার্থ বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। দীর্ঘদিন পদবঞ্চিত থেকে পদায়িত হলেন তিনি।
১১ উপদেষ্টা
মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক থেকে জহির উদ্দিন স্বপনের উপদেষ্টা পরিষদে পদোন্নতির প্রতিক্রিয়ায় উপদেষ্টা পরিষদের এক নেতা বলেন, রাজনৈতিক দুর্যোগ ওয়ান ইলেভেনের সময় দল ভাঙার ষড়যন্ত্রে যিনি লিপ্ত ছিলেন, গণমাধ্যমে দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতেন তাকে উপদেষ্টা পরিষদের টপ চার্টে রাখা হয়েছে। সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দীন, যুগ্ম মহাসচিব থেকে মুজিবুর রহমান সরোয়ার, হারুন অর রশিদ, আসলাম চৌধুরী এবং সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে সাখাওয়াত হাসান জীবনের উপদেষ্টার পদে পদায়ন যথার্থ হলেও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে নিয়ে স্থায়ী কমিটিতে মহাসচিব পদে নেতাদের আলোচনা থাকলেও তাকে উপদেষ্টা পরিষদে দিয়ে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে উপদেষ্টা পরিষদে পদায়ন করে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। মূলত কিছুদিন আগে আইন সম্পাদক কায়সার কামালের কূটচালে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কার হন এ এইচ মাহবুব উদ্দিন খোকন। চলমান রদবদলে কায়সার কামালের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব রয়েছে সে কারণে তাকেও অবমূল্যায়ন করে উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়েছে। তবে সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে বেবী নাজনীনকে, সহ-তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে খালেদ হোসেন চৌধুরী পাহিনকে উপদেষ্টা পরিষদে পদায়ন করে অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে।
তিন যুগ্ম মহাসচিব
প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের যুগ্ম মহাসচিব পদে পদায়ন যথার্থ হলেও সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে আব্দুস সালাম আজাদের যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে পদায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
চার সাংগঠনিক সম্পাদক
ময়মনসিংহ বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে মো. শরিফুল আলমকে এবং সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জিকে গউছকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে পদায়ন যথার্থ হলেও ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুলকে এবং রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহিন শওকত খালেককে বিভাগীয় সাংগঠনিক হিসেবে পদায়ন করায় প্রশ্ন উঠেছে। তিন মাস হয়নি বাবুল প্রমোশন পেয়েছেন, এই সময়ে তিনি কী এমন করলেন যে তাকে আবারও প্রমোশন দেওয়া হলো? শাহীন শওকতকে ঘিরে আন্দোলনের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠলেও তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন!
৬ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক
সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিমের সহ-সংগঠনিক সম্পাদক পদে পদায়ন যথার্থ হলেও সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ঢাকা বিভাগ, নির্বাহী কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, মীর হেলাল চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, আবু ওয়াহাব আকন্দ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ময়মনসিংহ বিভাগ, মিফতাহ সিদ্দিকী সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেট বিভাগের এই পদয়নকে অতিমূল্যায়ন হিসেবে দেখছেন নেতাকর্মীরা।
তিন সম্পাদক
জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে দলের প্রচার সম্পাদক করা অবস্থাদৃষ্টে পদায়ন মনে হলেও এটাকে এক ধরনের সাংগঠনিক শাস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। আন্দোলন চলাকালে তিনি পুলিশের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে নেতাকর্মীদের ফেলে দৌড় দিয়েছিলেন যা সুলতানি দৌড় হিসেবে আখ্যা পায়।
বলা হচ্ছে, এর আগে যুবদলের সভাপতি হিসেবে মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বরকত উল্লাহ বুলু বা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের যে পদোন্নতি হয়েছে সেই তুলনায় টুকু পদবঞ্চিত হয়েছেন। কারও মতে, টুকুকে যুববিষয়ক সম্পাদক পদে পদায়ন করে প্রচার সম্পাদক পদে মিডিয়াবান্ধব কাউকে পদায়ন করা দরকার।
সহ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মোর্শেদ হাসান খানকে গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক পদে পদায়ন করা হয়েছে। এই মোর্শেদ হাসান খান ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। এজন্য পরবর্তী সময়ে তিনি ক্ষমাপ্রার্থনাও করেন। সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীমকে গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক করাটাও অতিমূল্যায়ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তিন সহ-সম্পাদক
মো. নজরুল ইসলাম সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, এস এম সাইফ আলী সহ-তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এবং জর্জিয়া বিএনপি সভাপতি নাহিদ খানকে সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে।
১৪ নির্বাহী সদস্য
দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ, ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, জাহান পান্না (রাজশাহী), নাজমুন নাহার বেবী (চাঁদপুর), বেলায়েত হোসেন মৃধা (নরসিংদী) এদের যুক্ত করা যথার্থ হলেও আজম খান (দক্ষিণ আফ্রিকা), মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টু (সুইডেন), গাজী মনির (ডেনমার্ক) এদের অস্বাভাবিক মূল্যায়ন করা হয়েছে। আবার মো. মাইনুল ইসলাম (টাঙ্গাইল)-কে সদস্য করা অবমূল্যায়ন হয়েছে। সম্পাদক না হলেও ন্যূনতম একটি সহ-সম্পাদক পদ তার প্রাপ্য বলে অনেকেই মনে করেন।
দলের চলমান পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল ,আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামালদের যারা অনুসারী রয়েছে তাদের পদোন্নতি হয়েছে। এর বাইরে কারো পদোন্নতির সুযোগ হচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের বৈদেশিক উপদেষ্টা কমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে আব্দুল মঈন খানের দীর্ঘদিনের যে নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সেখানে মঈন খানের জয় হয়েছে।—নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি’র একজন ভাইস চেয়ারম্যান
এছাড়া জালাল উদ্দিন মজুমদার (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিভাগ), সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, রংপুর বিভাগ), সায়েদুল হক সাঈদ (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, কুমিল্লা বিভাগ), চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল ফারুক (সহ-কৃষি বিষয়ক সম্পাদক) এবং এস এম গালিবকে (সহ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক) বর্তমান পদ হতে নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে নিয়ে আসা চরম অবমূল্যায়ন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীদের একাংশ।
এক মিডিয়া সেল
বিএনপির মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেলকে আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। অথচ ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্বে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি বিটের সাংবাদিকদের কাছেই তিনি অপরিচিত এবং অধরা।
পদ রদবদল হওয়া নেতাদের ভাষ্য
জাতীয়তাবাদী কৃষক দল থেকে প্রথমবারের মতো বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন মাইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ নির্বাহী কমিটিতে জায়গা পেয়েছি এই কারণে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
রংপুর বিভাগীয় সহ-সংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে যা করছেন এটা দলকে শক্তিশালী, গতিশীল করবে এবং আগামী আন্দোলনে এটার পজিটিভ রেজাল্ট পাবো ইনশাল্লাহ।
পদ প্রত্যাশিত ছিল কি-না জানতে চাইলে নবনিযুক্ত রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘হ্যাঁ প্রত্যাশিত, প্রত্যাশা ছিল ২০০৮ সাল থেকে দপ্তরে কাজ করছি। অন্তত ১২শ’ রাত পার্টি অফিসের সোফায়, মেঝেতে অর্ধঘুম-নির্ঘুম কাটিয়েছি।’
আরও পড়ুন:
- রাকিব-নাছিরের নেতৃত্বেই ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি
- বিএনপির ৩ মহানগর ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত
দলের সাংগঠনিক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর যে রদবদল হলো সেখানে ভবিষ্যতে এই ধরনের অভিযোগ সামনে আসবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে আমিনুল বলেন, আমার ব্যাপারে বলতে পারি, আমার জন্য দোয়া করবেন, সবার কাছে দোয়া চাই। যেন অর্থ কেলেঙ্কারি আমাকে স্পর্শ করতে না পারে। এ ব্যাপারে আমি একদম শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে চাই আল্লাহ পাকের ওপর ভরসা করে।
নতুন প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ‘অবশ্যই আমি খুশি। আমার চেয়ারম্যান এ জায়গায় আমাকে যোগ্য মনে করেছেন। চেয়ারম্যান সাহেবের সিদ্ধান্ত হচ্ছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, ঊনি যেটা করেছেন আমি সাধুবাদ জানাই। আমার ওপর ঊনি যে আস্থা রেখেছেন আমি এই আস্থা অনুযায়ী কাজ করবো ইনশাআল্লাহ।’
যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘সাংগঠনিক পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া তারই অংশ হিসেবে পুনর্গঠন হয়েছে। এখানে নতুন কিছু নেই। এবার একসাথে অনেক পদে রদবদল হওয়ার কারণে এটি আলোচনায় এসেছে। আমার জায়গা থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এবং আমি তার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করবো।’
যুগ্ম মহাসচিব পদে অন্যদের পদায়ন যথার্থ কি-না জানতে চাইলে প্রিন্স বলেন, ‘আমি আমার অবস্থান থেকে এটা পরিমাপ করতে পারবো না। যাদের পরিমাপ করার ক্ষমতা আছে তাদের অবস্থান থেকে অনেক কিছু বিবেচনা করে এগুলো করেন। এটার মানদণ্ড আমার কাছে না, পরিমাপের মাপকাঠি এটা আমার কাছে না, ওনাদের কাছে। আমি মনে করি এ দলে সবারই কন্ট্রিবিউশন আছে। কারও কম কারও বেশি। কারও অবদান এখানে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।’
উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাহাবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আমি হ্যাপি এবং আমি মনে করি দলের চলমান প্রক্রিয়া এটা। এ কারণে কারও প্রমোশন হয়েছে কারও ডিমোশন হয়েছে। আমার মনে হয় যারা জাতীয়তাবাদী আদর্শ বিশ্বাস করে তাদের এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, আমি আমৃত্যু রাজনীতি করতে চাই সুতরাং আস্তে আস্তে যাওয়া ভালো। এটাতে আমি হ্যাপি। ঈমানের সঙ্গে দলে কাজ করলে মূল্যায়ন হবে।
উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘জন্ম থেকে আছি। দলটার জন্য যে মায়া বা দরদ সেই দরদের প্রতিফলন সারাজীবন দেখানোর চেষ্টা করেছি। সামনেও চেষ্টা করবো এবং যতদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকি সেই চেষ্টা ততদিন অব্যাহত থাকবে।
পদ স্থিতিশীল নেতারা যা বলছেন
যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন-নবী খান সোহেল বলেন, কর্মীদের সংগঠিত করার জন্য অনেক সময় অনেক রকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আগামী আন্দোলন কর্মসূচিকে বিবেচনায় রেখে সে রকম সিদ্ধান্ত এখন নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের পুরোনো সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, অবমূল্যায়ন কোথাও হচ্ছে না, সত্যিকার জাতীয়তাবাদী কর্মী হিসেবে তারেক রহমান যাদের চেনেন তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অভিজ্ঞতার আলোকে সিনিয়রদের সঙ্গে আলোচনা করে তারেক রহমান যে কমিটি দিয়েছেন সেটা অত্যন্ত সঠিক মূল্যায়ন করেছেন নেতাদের প্রতি। এতে দলের কোনো ক্ষতি হবে না। দলে দীর্ঘদিন কাউন্সিল হয় না চলমান সংকট আন্দোলন সংগ্রাম সরকারের দমন-নিপীড়ন এ কারণে চলমান প্রক্রিয়ায় দলের পরিবর্তন হচ্ছে এটা আসতে থাকবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সংগঠনে প্রত্যেকের একটা জবাবদিহি থাকে। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি সেটা সঠিকভাবে পালন না করলে সেক্ষেত্রে বেটার রিপ্লেসমেন্ট মাস্ট।
তিনি বলেন, পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সাংগঠনিক প্রয়োজনেই দলে বিভিন্ন সময় শূন্য পদ পূরণ, ছোটখাটো রদবদল করা হয়। এবারও সেটা করা হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে এতে দলের ভালোই হবে। এতে করে আগামীতে সংগঠন আরও সুসংহত, গতিশীল হবে।
কেএইচ/এসএইচএস/এমএস