সরকারে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ, সংগঠন কি দুর্বল হচ্ছে?
- মন্ত্রিসভার ১২ সদস্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা
- সরকারি পদে যতটা ব্যস্ত ঠিক ততটাই কম ব্যস্ত দলীয় কাজে
- বিভিন্ন নির্বাচনেই বেশিরভাগ সময় পার দলটির
- ৭৮ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৩৯টির মেয়াদ শেষ
- বিভিন্ন শাখার সম্মেলন ও কমিটি গঠনে আগ্রহ নেই
দল ও সরকারে একাকার আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন ধরে দল ও সরকার পরিচালনায় আলাদা নেতৃত্বের আলোচনা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং ক্রমশ সরকারে বিলীন হতে চলেছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা ধরে রাখতে বা সরকারে সফল হতে গিয়ে দলটির সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয় হচ্ছে। বছরের বেশিরভাগ সময় নানান নির্বাচনে পার করছে সময়। সংগঠনে থাকছে না মনোযোগ। এতে গোছানো হচ্ছে না দল, ঢিমেতালে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছে। এ সরকারের মন্ত্রিসভার ১২ সদস্য আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা। আছেন জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও। এছাড়া সংসদীয় কমিটির সভাপতি, জাতীয় সংসদের হুইপসহ নানান জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
সরকারের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি টানা চারবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২২ সালে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দশমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। তিনিও টানা তৃতীয় মেয়াদে এই দায়িত্ব পেয়েছেন। একই সঙ্গে ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
আরও পড়ুন
ড. হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। গত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনিকে করা হয়েছে নতুন সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী। এছাড়া নতুন মন্ত্রিসভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রলায়ের দায়িত্ব পেয়েছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সিমিন হোসেন রিমি পেয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ফাইল ছবি
নতুন সরকারে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খান, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন দলের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক বেগম সামসুন নাহার (চাপা), স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন দলের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, দলটির কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন।
এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদে হুইপ নিয়োগ পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মাশরাফি বিন মর্তুজা ও কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাভোকেট ড. সানজিদা খানম।
আরও পড়ুন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের এসব পদে তারা যতটা ব্যস্ত ঠিক ততটাই কম ব্যস্ত দলীয় কাজে। হাতেগোনা কয়েকজন নেতা ছাড়া বেশিরভাগ আসেন না দলীয় কার্যালয়েও।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেই সিংহভাগ সময় ব্যয় হয়েছে দলটির। দলের সম্মেলন, কমিটি গঠন ও সাংগঠনিক কর্মসূচির চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে সরকারি বা জাতীয় কর্মসূচি। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় গেলেও এই সময়ে দলটির জাতীয় সম্মেলন হয়েছে পাঁচবার। এর মধ্যে স্থানীয় সরকারের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনগুলো নিয়মমাফিক করলেও সেভাবে দলের শাখা সম্মেলন ও কমিটি গঠন হয়নি।
জানা গেছে, দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এরই মধ্যে ৩৯টির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এগুলোতে সম্মেলন ও কমিটি গঠনে মনোযোগ নেই আওয়ামী লীগের। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোও বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় কমিটিনির্ভর। শাখার সম্মেলন ও কমিটি গঠনে তেমন আগ্রহ নেই।
আরও পড়ুন
- আওয়ামী লীগ ভীত হয়ে নিজেরাই মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছে: সেলিমা
- শেখ হাসিনার হাতেই গণতন্ত্র নিরাপদ: ওবায়দুল কাদের
দলীয় তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে জাতীয় সম্মেলনের আগে সারাদেশে নিয়ম রক্ষার সম্মেলন করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির সাংগঠনিক জেলা ৭৮টির মধ্যে ৩৯টির সম্মেলন করেছিল। সম্মেলন করেনি ৩৯টির। সম্মেলন হওয়া ৩৯টির মধ্যে প্রায় সবকটিতেই সভাপতি-সম্পাদকনির্ভর কমিটি হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে মাত্র সাতটি জেলা।
অন্যদিকে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি ২৪টিতে এবং নেতৃত্বের আংশিক পরিবর্তন হয়েছে আটিতে। উপজেলা পর্যায়েও একই চিত্র। ১৫ থেকে ১৮-২০ বছর সম্মেলন হয়নি এমন উপজেলায়ও সম্মেলন হয়েছে। তবে ২০২২ সালের সম্মেলনের পর নতুন করে কোনো শাখার সম্মেলন বা কমিটি হয়নি। যদিও হাতেগোনা কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দলীয় কার্যালয়েও নিয়মিত নন
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বছর আমরা সাংগঠনিক কাজে মনোনিবেশ করবো। আমাদের মেয়াদোত্তীর্ণ শাখাগুলোর সম্মেলন করার চিন্তা-ভাবনা আছে। আমরা বছরটি সম্পূর্ণ সাংগঠনিক কাজে ব্যয় করতে চাই, ইনশাআল্লাহ।’
আরও পড়ুন
- রমজানের মধ্যেও বিএনপির কর্মসূচি জনভোগান্তি সৃষ্টি করবে: কাদের
- নিত্যপণ্য: জনগণ দিশেহারা, মন্ত্রীরা করছেন তামাশা: মঈন খান
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত জাতীয় সম্মেলনের আগে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রায় সব ইউনিটের সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের কারণে সবগুলো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন ও অনুমোদন হয়নি। এগুলো নিয়ে কাজ চলছে। যেসব কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে বা অদূর ভবিষ্যতে হবে সেগুলোর সম্মেলন এ বছর এবং আগামী বছর অনুষ্ঠিত হবে। আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগেই সব পর্যায়ের মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিটের সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন এবং অনুমোদন সম্পন্ন হবে। সম্মেলন একটি নিয়মিত কার্যক্রম।’
দলটির আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। এর তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত অত্যন্ত সুসংগঠিত। তৃণমূল হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি। তৃণমূলসহ সব পর্যায়ের কমিটি গঠনে কেন্দ্র প্রস্তুত থাকে। দলীয় ফোরামে এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ শাখার সম্মেলন ও সম্মেলন হয়ে যাওয়া শাখাগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী সম্মেলনের আগেই সব শাখা সম্মেলন করে নতুন কমিটি নিশ্চিত করা হবে।’
এসইউজে/ইএ/এমএস