ঢাকা-৭
নৌকাকে রুখতে লাঙ্গলের লড়াই
পুরান ঢাকার বড় একটি অংশ নিয়ে গঠিত ঢাকা-৭ আসন। একসময়ে বিএনপির ঘাঁটি গত ১৫ বছরে রূপান্তরিত হয়েছে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে। হাজী সেলিম একবার স্বতন্ত্র থেকে পাস করলেও তিনি পরে নৌকায় ভেড়েন। এবার এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তার বড় ছেলে সোলায়মান সেলিম। ভোটের মাঠে রয়েছেন আরও পাঁচজন প্রার্থী। তাদের মধ্যে প্রচারণা ও গণসংযোগে এগিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুদ্দীন আহমেদ মিলন। ভোটের মূল লড়াইটা হবে নৌকা ও লাঙ্গলের মধ্যে।
সংসদ নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারা এর আগে আমার বাবার সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। জনগণের সাড়া তারা সেভাবে পাননি। তারা তাদের প্রচারণা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তারা অভিযোগ করে থাকতে পারেন সেগুলো নির্বাচন কমিশন যাচাই করবে।- সোলায়মান সেলিম
ঢাকা-৭ আসনের গত ছয়টি সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ আসনে সবশেষ তিনটি নির্বাচনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীও ছিলেন আওয়ামী লীগের। এর আগে টানা তিনটি নির্বাচনে জয় পায় বিএনপি। তিনটি নির্বাচনেই বিএনপির প্রার্থী ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রায় ২৩ হাজার ভোটে হারান।
আরও পড়ুন>> সর্বোচ্চ ভোট পড়ে নবমে, ষষ্ঠে সর্বনিম্ন
১৯৯১-২০০৮ পর্যন্ত পুরান ঢাকার অন্যতম এ আসনটিতে বিএনপির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আসনটি বিএনপির হাতছাড়া হয়। এ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী নাসির উদ্দীন পিন্টু হারেন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনের কাছে। এরপর থেকে এ আসনে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি তৈরি হয়।
এ আসনে গত দুবারের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় তার দুই পুত্র ইরফান সেলিম ও সোলায়মান সেলিমের নামে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। পরে আওয়ামী লীগ থেকে বড় ছেলে সোলায়মান সেলিমকে নৌকার টিকিট দেওয়া হয়।
প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই জোরেশোরে প্রচারণা চালান সোলায়মান সেলিম। পুরান ঢাকায় এ পরিবার নানান কারণে আলোচিত-সমালোচিত। ঢাকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জায়গা দখল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি, ভবন, মার্কেট দখল, নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় ইরফান সেলিম গ্রেফতার হওয়াসহ রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগ। তবে সোলায়মান সেলিমের নামে সরাসরি তেমন কোনো অভিযোগ নেই।
পুরান ঢাকার একাংশ ঘুরে দেখা যায়, রাস্তাঘাট, অলিগলিতে ছেয়ে গেছে নৌকার পোস্টার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বড় করে সাঁটানো হয়েছে ব্যানার। মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সোলায়মান সেলিমের জন্য কাজ করছেন। এবার প্রথম প্রার্থী হওয়ায় বেশ উচ্ছ্বসিত নৌকার এই মাঝি। বাবার আসনে প্রার্থী হওয়ায় সবার কাছ থেকে সমর্থনও পাচ্ছেন বেশ।
আরও পড়ুন>> ফাঁকা মাঠে নসরুল হামিদের একক আধিপত্য
সোলায়মান সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজে প্রার্থী হয়ে আমি অসাধারণ সাড়া পাচ্ছি। আমার বাবা দীর্ঘদিনের সংসদ সদস্য। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও দলমত নির্বিশেষে সবার ভোটে জয়লাভ করেছেন। সেক্ষেত্রে ওনার একটি নিজস্ব ভোটব্যাংক আছে এবং আওয়ামী লীগেরও একটি ভোটব্যাংক আছে।’
তিনি বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারা এর আগে আমার বাবার সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। জনগণের সাড়া তারা সেভাবে পাননি। তারা তাদের প্রচারণা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তারা অভিযোগ করে থাকতে পারেন সেগুলো নির্বাচন কমিশন যাচাই করবে।’
এ নির্বাচন এক প্রকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। পাস না করলে আর কোনোদিন নির্বাচন করবো না। মানুষের প্রচুর সমর্থন আমার প্রতি। সবাই আমাকে চেনে। পুরান ঢাকার সবাই আমার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী। তবে আমি কেন্দ্র দখল নিয়ে শঙ্কিত।- সাইফুদ্দীন মিলন
নৌকার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে প্রচারণায় দেখা গেছে জাপার প্রার্থী সাইফুদ্দীন আহমেদ মিলনকে। তিনি ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে খ্যাত। নৌকার পাশাপাশি এই প্রার্থীরও প্রচুর পোস্টার-ব্যানার দেখা গেছে। চকবাজার, লালবাগের অলিগলিজুড়ে তার পোস্টার সাঁটানো। প্রতিদিন গণসংযোগও চালিয়ে যাচ্ছেন। জয়ের ব্যাপারে এই প্রার্থী শতভাগ আশাবাদী। তবে কেন্দ্র দখল ও ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে তার।
সাইফুদ্দীন মিলন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ নির্বাচনকে এক প্রকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। পাস না করলে আর কোনোদিন নির্বাচন করবো না। মানুষের প্রচুর সমর্থন আমার প্রতি। সবাই আমাকে চেনে। পুরান ঢাকার সবাই আমার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী। তবে আমি কেন্দ্র দখল নিয়ে শঙ্কিত। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা রয়েছে। ঢাকা-৭ আসনে সরকারদলীয় প্রার্থী নির্বাচনী আচার-আচরণ কিছুই মানছেন না।’
আরও পড়ুন>> শক্ত অবস্থানে ফেরদৌস, প্রচারে পাল্লা দিচ্ছেন অন্যরাও
ঢাকা-৭ আসনে নৌকা ও লাঙ্গল ছাড়াও চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের নূরজাহান বেগম ছড়ি প্রতীকে, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির আফসার আলী একতারা প্রতীকে, লা ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মাসুদ পাশা আম প্রতীকে ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মোহাম্মদ ইদ্রিস ব্যাপারী মশাল প্রতীকে নির্বাচন করছেন। তবে এই চার প্রার্থীকে প্রচার-প্রচারণায় খুব একটা দেখা যায়নি। রাস্তাঘাটে তাদের পোস্টার-ব্যানারও তেমন দেখা যায় না।
চকবাজারের ব্যবসায়ী গফুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ আসনে তো স্বতন্ত্রও নেই। প্রার্থী যারা আছেন, এক-দুজন ছাড়া কেউ আসেনি। আম, ছড়িসহ অনেক মার্কা দেখলাম এদের সঙ্গে পরিচিতি নেই। তাদের পক্ষে নেতাকর্মীদের প্রচারও এখনো দেখিনি।’
বংশালের বাসিন্দা কবির মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ এলাকায় তো হাজী সেলিম প্রভাবশালী, তার ছেলেই জিতবেন। প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে তাদের লিফলেট হাতে পাচ্ছি। তবে নির্বাচনের কোনো আমেজ দেখছি না।’
এ আসনের সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট মনোনীত প্রার্থী নূরজাহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি শেষ দুদিন প্রচারণা করবো। এখন গণসংযোগ করছি। নৌকা ও লাঙ্গল প্রতীকের কারণে তো পোস্টার লাগানোর জায়গাই পাই না। কোনো খালি জায়গা নেই। দেওয়ালে কিছু পোস্টার লাগিয়েছি। যারা সমর্থন করেন তারা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভোটকেন্দ্রে আসবেন। তবে অনেক ভোটার কেন্দ্রে ঝামেলা হওয়ার ভয়ে আসবেন না।’
ঢাকা-৭ আসনটি জাতীয় সংসদের ১৮০ নম্বর আসন। ঢাকা মহানগরের বংশালের একাংশ, কোতোয়ালির একাংশ, চকবাজার, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ ও ধানমন্ডির একাংশ নিয়ে গঠিত। এ সংসদীয় আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৪৩ হাজার ১২৯। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ ও নারী ভোটার ১ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৮ জন। এছাড়া একজন হিজড়া ভোটারও রয়েছেন।
আরএএস/এএসএ/জেআইএম