ইশতেহার ঘোষণা
ক্ষমতায় গেলে যা যা করবে জাপা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলীয় ইশতেহার ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। ‘শান্তির জন্য পরিবর্তন, পরিবর্তনের জন্য জাতীয় পার্টি’ এ স্লোগান সামনে রেখে দলটির ইশতেহারে ২৪টি প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টায় জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় মিলনায়তনে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এ ইশতেহার ঘোষণা করেন। দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর এটিই জাপার প্রথম সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার।
আরও পড়ুন: ‘শান্তির জন্য পরিবর্তন’ স্লোগানে জাপার ইশতেহার
ঘোষিত ইশতেহারে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধ, দেশের চলমান বাস্তবতায় কর্মসংস্থান, বিকেন্দ্রীকরণ, বিচারব্যবস্থা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ঘোষণাসমূহ উঠে এসেছে।
ইশতেহারে আরও বলা হয়েছে, কোরাআন সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না দলটি। ৫০ শতাংশ অফিস করা হবে ঢাকার বাইরে।
যা আছে ইশতেহারে
ইশতেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে জাতীয় পার্টি দেশে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে। আট বিভাগকে ৮টি প্রদেশে উন্নীত করা হবে। নাম হবে– উত্তরবঙ্গ প্রদেশ, বরেণ্য প্রদেশ, জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশ, জাহানাবাদ প্রদেশ, জালালাবাদ প্রদেশ, চন্দ্রদ্বীপ প্রদেশ, ময়নামতি প্রদেশ ও চট্টলা প্রদেশ।
এছাড়া সরকার কাঠামো হবে দুই স্তরবিশিষ্ট। কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হবে ফেডারেল সরকার। থাকবে ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদ। আর প্রদেশ চালাবে প্রাদেশিক সরকার। থাকবে প্রাদেশিক সাংসদ। প্রতিটি উপজেলা কিংবা থানাকে প্রাদেশিক সরকারের আসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ঢাকা থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সদরদপ্তর প্রাদেশিক রাজধানীতে স্থানান্তর করা হবে।
আরও পড়ুন: চমক নিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার
ক্ষমতায় গেলে নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে জাতীয় পার্টি ইশতেহারে। বর্তমান ব্যবস্থার বদলে ভোটের আনুপাতিক হারে জয়-পরাজয় নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হবে। নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হবে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’।
উপজেলা আদালত ও পারিবারিক আদালতসহ পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস্থা চালু করে স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করতে চায় জাতীয় পার্টি। সরকার গঠন করতে পারলে উপজেলার ক্ষমতা উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে হস্তান্তর করবে তারা।
জাতীয় পার্টি বিচার বিভাগ ও ইসিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখবে। বাজেট ও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া ৭০ ধারা সংশোধনের মাধ্যমে সব প্রতিনিধিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আওতায় এনে সংসদকে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
ক্ষমতায় গেলে নিবর্তনমূলক কালা কানুন বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাতীয় পার্টি। নিম্ন আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো হবে। বিচারকদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও বাড়বে। এছাড়া প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে পৃথকীকরণ করতে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।
একই সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থার অনিয়ম, দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রতা ও অব্যবস্থার মূল কারণ উদঘাটন করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে গঠন করা হবে কমিশন, যা ছয় মাসের মধ্যে তাদের সুপারিশ প্রদান করবে। দেশের বিজ্ঞ আইনজ্ঞ এবং জুরিস্টদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় আইন কমিশন গঠন করবে দলটি।
আরও পড়ুন: জাপাকে ২৬ ও শরিকদের ৬টি আসন দিলো আওয়ামী লীগ
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো হবে। গ্রাম ও শহরে ওয়ার্ড পর্যায় থেকে বেকার যুবক-যুবতিদের তালিকা প্রণয়ন করা হবে। যোগ্যতা অনুসারে বেকারদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র নিরূপণ করা হবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বেকার যুবক-যুবতিদের কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত সরকারিভাবে তাদের ভাতা প্রদান করা হবে।
ক্ষমতায় গেলে পরবর্তী পাঁছ বছরের মধ্যে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ সেবা নিশ্চিত করতে ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করবে জাতীয় পার্টি।
সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষায় বেশি জোর দেওয়া হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞান শিক্ষার সমন্বয় ঘটাবে জাপা। কমানো হবে শিক্ষা উপকরণের দাম। দাখিল-আলিম-ফাজিল-কামেল পাসের মান এসএসসি, এইচএসসি, বিএ ও এমএ’র সমপর্যায়ে করবে দলটি।
নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতায় গেলে কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাপা। সরকারকে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়ার উদ্দেশে দেশের বিশিষ্ট আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে একটি ইসলামিক কমিশন গঠন করবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখবে দলটি। এছাড়া বিশ্ব ইজতেমা প্রাঙ্গণে ১০ লাখ লোকের স্থান সংকুলানের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করবে।
সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূলে কঠোর অবস্থানে থাকবে দলটি, কৃষিভিত্তিক শিল্প নগরী গড়ে তোলা হবে। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষাক্ত পদার্থ মেশানোর বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হবে।
নতজানু নীতি পরিহার করে সমতাপূর্ণ কূটনীতিক দক্ষতা দেখাতে চায় দলটি। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন পর্যায়ক্রমে বাড়ানোর কথাও জানিয়েছে জাপা।
আরও পড়ুন: জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ সমঝোতার নেপথ্যে
ইশতেহারে বলা হয়েছে, দেশ এখন ভয়াবহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গোটা বিশ্ব এখন নতুন শতাব্দিতে পদার্পণ করছে। এ সময়ে বিশ্বের দেশসমূহ নতুন তথ্যপ্রযুক্তি অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আর পিছিয়ে পড়ে থাকার অবকাশ নেই। জাতীয় পার্টি ৯ বছরের শাসনকালে দেশের কল্যাণ ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল। আজ সে কারণে জনসাধারণের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামগ্রিক জীবনে সেই সময় সোনালী অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। জাতীয় পার্টি এখন সুখী, সমৃদ্ধ এবং আধুনিক দেশ গড়ার লক্ষ্যে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
নানা নাটকীয়তার পর গত ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়। এবার দলটি এককভাবে ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দিলেও ২৬টি আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে ১৬টি আসনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীরা ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
এসএম/এমকেআর/এএসএম