রাজনীতিতে হেভিওয়েটদের ডায়েটে যাওয়া উচিত
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সম্পাদক হিসেবেও পরিচিত। দীর্ঘ সময় বাবা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন। মঞ্জু কাউখালী, ভান্ডারিয়া ও জিয়ানগর উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর-২ আসন থেকে আটবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। মন্ত্রী ছিলেন প্রায় ২০ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা এই রাজনীতিকের মুখোমুখি হয় জাগো নিউজ। জোট গঠন, আসন বণ্টন ও রাজনীতি নিয়ে বেশ খোলামেলা কথা বলেছেন এই রাজনীতিক। রাজনীতি চর্চায় দলগুলোর নিয়ন্ত্রিত ও নিয়মতান্ত্রিক আচরণ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বলেছেন, ‘বর্তমানে যারা হেভিওয়েট আছে, তাদের ডায়েটে যাওয়া উচিত। একটা বয়সের পরে ওজনটা স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন।’
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সালাহ উদ্দিন জসিম।
জাগো নিউজ: আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত কি না বা আপনার অংশটুকু কনফার্ম কি না?
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু: না। কনফার্ম না। সেদিন যে প্রধানমন্ত্রী বসেছিলেন। দেশি-বিদেশি সব বিষয়ে তিনি আলাপ করেছিলেন। আর সিট কাকে কয়টা দেবেন, এটা তিনি আমাদের আমু ভাইসহ আরও চার-পাঁচজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে বসেছেন। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আরও বৈঠক হবে। তবে, ১৭ তারিখ তো শেষ সময়।
জাগো নিউজ: শোনা যাচ্ছে, আপনিসহ চার শরিক প্রধানের আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। এটি ঠিক কি না?
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু: আমি দেনদরবার করার লোক নই। জোট করেছি জেতার জন্য। আমার যেমন বড় দলটার প্রয়োজন আছে, বড় দলটারও নিশ্চয়ই আমাকে প্রয়োজন আছে। তা না হলে আমাকে রাখবে কেন? এটা আমার ধারণা। তবে, আমার কোনো (আসন নিয়ে) চাহিদা না থাকলেও দলের অন্য যারা আমার সঙ্গে এত বছর টিকে আছে, তাদের তো চাহিদা আছে। আমাদের তো টিকে থাকার কথাই না। তারপরও তো আছি। তাই না? এবং সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব আছে। অনেক ছোট দলের মধ্যে আমরাও ছোট দল। কিন্তু সংসদের আমাদের প্রতিনিধিত্ব আছে। জোটের মধ্যে থেকেও আমি আমার নিজের মার্কায় নির্বাচন করেছিলাম।
যাদের সঙ্গে আমরা জোটবদ্ধ হয়েছি, তাদের মধ্য থেকে যদি কেউ আবার তার দলের প্রার্থীও দেয় তাহলে সেটা ঐক্যের যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, তার পরিপন্থি। কে জিতবে, কে হারবে এটা আমি বিশ্লেষণ করি না। নির্বাচনে দাঁড়ালে পরে হার জিত আছে, এই মানসিকতা থাকতে হবে।
জাগো নিউজ: এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরা উন্মুক্ত। বেশিরভাগ আসনেই স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী আছে। জোটকে ছেড়ে দিয়ে আবার সেখানে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকাটা দ্বন্দ্বের তৈরি করে কী?
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু: দ্বন্দ্ব যারা বাধাতে চায়, তারা যে কোনো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব করতে পারে। কথাটা হলো- আমাদের উদ্দেশ্য কী? একে অপরের প্রয়োজন আছে, কম বা বেশি। জয়লাভ করতে হবে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। এই তো দুই অবজেক্টিভ। প্রথম বিচারে হোক, শেষ বিচারে হোক- প্রধানমন্ত্রী বা জোটের প্রধান সিদ্ধান্ত নেবেন। তার সিদ্ধান্ত শেষ সিদ্ধান্ত। আমার সিদ্ধান্ত না, আমির হোসেন আমুর সিদ্ধান্ত না বা কারও সিদ্ধান্ত না।
আরও পড়ুন>>জোট না থাকলে আওয়ামী লীগ একা হয়ে যাবে
যাদের সঙ্গে আমরা জোটবদ্ধ হয়েছি, তাদের মধ্য থেকে যদি কেউ আবার তার দলের প্রার্থীও দেয় তাহলে সেটা ঐক্যের যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, তার পরিপন্থি। কে জিতবে, কে হারবে এটা আমি বিশ্লেষণ করি না। নির্বাচনে দাঁড়ালে পরে হার জিত আছে, এই মানসিকতা থাকতে হবে।
হেভিওয়েটরা জিতবেই, এরকম যদি হতো, তাহলে আপনারা হয়তো আমার নাম এক নম্বরে দিতেন। ৩৮ বছর আমি সংসদে। আমার ভোটারদের অর্ধেকের বেশি ৩৮ না। তারা আমার নাম শুনেছে, জন্মের পর থেকে। আমার কার্যক্রম দেখেনি। আমি যদি এখন বলি, আমার নির্বাচনী এলাকায় এগুলো ছিল না, ওগুলো ছিল না। তখন সে ভাববে প্রাইমারি থেকেই তো আমি এগুলো দেখে আসছি। যাদের বয়স বেশি, তারা হয়তো মজা করে গল্প করে বলবে- এখানটায় এমন ছিল, হাইট্টা গেছি, লুঙ্গি পরে গেছি, খাল পার হয়েছি, কিন্তু কম বয়সীরা তো এগুলো জানে না।
আরও পড়ুন>>‘আমরা একটি বিপজ্জনক ফাঁদের ভেতরে পড়ে যাচ্ছি’
এজন্য রাজনীতিবিদদের, জনপ্রতিনিধিদের সব সময় পরিবর্তনটার দিকে খেয়াল রাখতে হয়। আমাদের দেশে আছে, কিন্তু ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় না কিংবা ব্যক্ত করে না। শিল্পে উন্নত দেশগুলোতে ছোট ছোট বইয়ের দোকানেও এই পরিবর্তনের তথ্য পাবেন। কিন্তু আমাদের দেশে এই তথ্যের জন্য যেতে হয় সরকারি বিশেষ দপ্তরে। ফলে বেশিরভাগ প্রার্থী নিজের এলাকার জিওগ্রাফি, আর্থসামাজিক অবস্থা, জনসংখ্যার কত অংশ নারী, কত অংশ পুরুষ, এই ফিগারটা তার কাছে নেই। অতএব, সে যখন বক্তব্য রাখে- প্রথম জানতে হবে কাকে অ্যাড্রেস করছি। কলেজে গিয়ে তো রাজনীতির বক্তব্য দেওয়া যাবে না। যদিও করে।
আমি লুজিংওয়েট আপনারা জানেন। আমার দৃষ্টিতে, সবাই লুজিংওয়েট। এর ভেতরে যারা হেভিওয়েট আছে, তাদের ডায়েটে যাওয়া উচিত। একটা বয়সের পরে ওজনটা স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন। আর ডায়েটিং করার মানে আপনার ওজনটা দ্রুত কমে যাচ্ছে। এটা সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যদি বিশ্লেষণ করেন, আমাদের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। আরও আসবে। এবার আমার যদি ৭ম বা ৮ম নির্বাচন হয় প্রথমে বলত তো অমুক ঘরের পোলা। এখন কিন্তু সেটা বলে না। নতুন প্রজন্ম শোনে, যে কোনো বিষয় তারা খেয়াল করে। আর আমাদের শিক্ষাটা সেভাবে বিস্তৃত হয়নি। আমাদের শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনার অবকাশ আছে। এটা জীবনধর্মী নাকি কর্মমুখী শিক্ষা? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হতে হবে, যার সঙ্গে জীবনের একটা সম্পর্ক থাকবে।
জাগো নিউজ: জোটের বিরুদ্ধে হেভিওয়েট প্রার্থী দিয়ে দিলেন, এটা জোটকে দুর্বল করে কি না?
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু: তর্কের খাতিরে আপনি বলতে পারেন, এরকম হওয়া উচিত নয়। আবার, অনেক দল তো অংশগ্রহণ করছে, এটা তো সত্য। অনেকে আবার হেভিওয়েট। আমি লুজিংওয়েট আপনারা জানেন। আমার দৃষ্টিতে, সবাই লুজিংওয়েট। এর ভেতরে যারা হেভিওয়েট আছে, তাদের ডায়েটে যাওয়া উচিত। একটা বয়সের পরে ওজনটা স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন। আর ডায়েটিং করার মানে আপনার ওজনটা দ্রুত কমে যাচ্ছে। এটা সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত। স্ট্রিকটলি কমছে, মোটামুটি তখন ডাক্তাররা আপনাকে সামান্য কিছু এদিক-সেদিক করতে পারে। অর্থাৎ, আমরা হেভিওয়েট বলতে কাউকে মানি না। আমাদের চিন্তার ঐক্য আছে। আমরা একমত। সেখানে আবার আমরা যে কটা দল মিলে ঐক্য করলাম, এদের মধ্যে আবার বিশ্লেষণ করলে দেখবেন কিছু পার্থক্য আছে অবশ্যই।
আরও পড়ুন>>সামনে সরকার কোনো বিপদ দেখছে না
আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলবো, এখানে চরম বামপন্থি আছে, বামপন্থি আছে, উগ্রপন্থি আছে, ধর্মপন্থি আছে। আমার সেরকম কোনো পন্থা নেই। আমাদের পন্থাটা হলো- আমরা লিবারেল ডেমোক্রেটস। যারা বামপন্থি রাজনীতি করে তারা হয়তো বলবে, এটা সুবিধাবাদী রাজনীতি। কিন্তু উদার মনের গণতন্ত্রী আমরা। বামপন্থিরা বই পড়ে নিজস্ব কতগুলো এজেন্ডা বানায়। সবার জন্য বাড়িঘর ইত্যাদি। আমি তো সেগুলো করতে পারি না। কারণ আমার দর্শনে সেটা নেই। কিন্তু অর্থনীতিকে এমন করতে হবে যেখানে বাড়িঘর, খাওয়া-দাওয়া, শিক্ষা, এগুলো অটোমেটিকালি সে আর্ন করতে পারবে।
জাগো নিউজ: এবার আপনাদের প্রতীকে কয়জন নির্বাচন করবে? আর নৌকা প্রতীকে কয়জন?
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু: দলীয় প্রতীক সাইকেল মার্কায় ২০ জনের বেশি হবে। তবে নৌকা তো তারা যতটুকু দেবে, ততটুকুই। দরকষাকষির লোক আমি না। আমার দলের অন্যরাও না। কারণ মৌলিক প্রশ্নটার উত্তর দিতে হবে; কেন আমরা ঐক্যবদ্ধ হলাম? জাহাজের সঙ্গে নৌকাও না, ডিঙি কেন বাঁধলাম? বড় জাহাজের সঙ্গে একটা ডিঙি যখন বাঁধে, তখন এই ডিঙির ফলফলাদি ওই জাহাজের ক্রুরা খায়, আবার ডিঙির লোকও বড় জাহাজ থেকে তেল-টেল কিছু পাইলে ওটা নিয়ে চলে যায়। একেকজনের একেক উদ্দেশ্য।
ছোট নৌকা বড় জাহাজের সঙ্গে কোন নোঙর ফেললো? নিশ্চয় দলের ভেতরে আলাপ করতে হবে। আমি মনে করি, এখন সে পর্যায় আমাদের রাজনীতিতে এসেছে। সেটা কী- কেন আমি যাচ্ছি? এই প্রশ্নটা যদি তার মনের ভেতর ঘোরাফেরা করে, তাহলে যথেষ্ট এই পর্যায়ে।
এসইউজে/এএসএ/জেআইএম