ছাত্রদলের ‘লোকদেখানো’ ছাত্র ঐক্য, বিশৃঙ্খল ও ফলশূন্য হওয়ার শঙ্কা
সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সমন্বয়ে ১৫টি ছাত্র সংগঠন নিয়ে গতকাল শুক্রবার আত্মপ্রকাশ করলো ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য’। সদ্য গঠিত এই ছাত্র ঐক্যে থাকা দুই থেকে তিনটি সংগঠন ছাড়া বাকিগুলো নতুন কিংবা কোনো বড় দল থেকে ছুট হওয়া ‘ব্র্যাকেটবন্দি’ ছাত্রসংগঠন। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের কোনো সক্রিয় কার্যক্রম ও শক্তিশালী অবস্থান নেই বললেই চলে। অনেকে বলছেন, ব্যানারসর্বস্ব এসব সংগঠন নিয়ে করা ঐক্য ছাত্রদলের ঘরে কী ফসল তুলে আনতে পারে সেটিই এখন দেখার বিষয়।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়তে পারে খোদ বিএনপির এই অন্যতম অঙ্গ সংগঠনটির মধ্যে। শুধু তাই নয়, রাজপথে আন্দোলন সফল করার চেয়ে নিজেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা এবং বিরোধী শিবিরের কাছে পরাজিত হওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে বলে মনে করেন ছাত্ররাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
ছাত্রদলের এই ঐক্যকে ‘লোকদেখানো’ বলছেন খোদ দলটির কয়েকজন নেতা। এছাড়া ছাত্রসংগঠনের কোনো কর্মসূচি ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে ঘোষণা করায় তার কার্যকারিতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে মাঠে থাকা কয়েকটি ছাত্রসংগঠন। এসব সংগঠনের নেতারা মনে করেন, ছাত্রসংগঠন বা জোট সম্পর্কিত কোনো কর্মসূচি বা ঘোষণা মধুর ক্যান্টিন থেকেই আসা উচিত ছিল। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক সেটি কার্যকর হতো ও গ্রহণযোগ্যতা পেতো।
আরও পড়ুন> ছাত্রদলের নেতৃত্বে ১৫ সংগঠনের ছাত্র ঐক্যের আত্মপ্রকাশ
ছাত্র ঐক্য নিয়ে বিরোধিতা করা ছাত্রদলেরই এক পক্ষ বলছে, ছাত্রদলের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা করতে ব্যর্থ বর্তমান নেতৃত্ব তাদের দুর্বলতা ঢাকতে এমন একটি ছাত্র ঐক্য গঠন করেছে, যা অন্তঃসারশূন্য। রাজপথের আন্দোলনে ছাত্রদলের যে স্বতন্ত্র অংশগ্রহণ সেটি অন্যের ব্যানারের কারণে সব অর্জন ম্লান করে দেবে।
বিএনপির প্রধান মিত্র দেশের ইসলামি ভাবধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। বাংলাদেশের ইসলামি ভাবধারার মানুষগুলো বিএনপির বড় সমর্থক বলে দাবি করেন দলটির নেতারা। বিভিন্ন কর্মসূচিতেও তাদের ইসলামি ভাবধারার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। কিন্তু তাদের ছাত্রসংগঠন দীর্ঘদিনের মিত্রদের শুধু ‘ইসলামি’ নাম থাকায় ঐক্যে অন্তর্ভুক্ত না করা এবং এড়িয়ে চলা নিয়েও প্রশ্ন ও অসন্তোষ রয়েছে।
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শরীফুল ইসলাম রিয়াদ জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন ইতিহাসের চরম সংকটময় সময় পার করছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল এ মুহূর্তে একটি কার্যকর ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠবে। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছিলাম। ছাত্রদল পল্টন অফিসে আমন্ত্রণও করেছিল। আমরা প্রায় ১৬টি ছাত্র সংগঠন স্বৈরাচারবিরোধী জোট গঠনে একমতও হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ছাত্রদল একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু তারা সেটি করতে পারেনি। এই জোট নিয়ে আমরা হতাশ এবং উদ্বিগ্ন।
আরও পড়ুন> ছাত্রদলের নতুন কমিটি হতে পারে শিগগির, শ্রাবণের ফেরা নিয়ে ধোঁয়াশা
তিনি অভিযোগ করে বলেন, শুরুতেই ছাত্রদের নিয়ে যে ঐক্য গঠন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেটিতে বিরোধের বীজ বপন করেছে ছাত্রদল। এখানে এমন কিছু ব্যক্তিকে রাখা হয়েছে যারা ‘আন্ডার টেবিল’ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
আবার ছাত্রশিবিরের সভাপতি রাজিবুর রহমান জানিয়েছেন, ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলো নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে একটি সরকারবিরোধী ছাত্র জোট গঠন করার কথা।
ছাত্র ঐক্যের সংগঠনগুলোর মাঠের যে পরিস্থিতি
জোটভুক্ত অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো হলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জেএসডি), গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি), নাগরিক ছাত্র ঐক্য, জাগপা ছাত্রলীগ, ছাত্র ফোরাম (গণফোরাম মন্টু), ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাতীয় ছাত্রসমাজ (কাজী জাফর), জাতীয় ছাত্রসমাজ (পার্থ), জাগপা ছাত্রলীগ (লুৎফর), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ, বিপ্লবী ছাত্র সংহতি এবং রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলন।
ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের সমন্বয়কারী হয়েছেন ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদিব এবং বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ড।
ছাত্র ঐক্যের মধ্যে শুধু ছাত্রদলের দেশের সব জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি আছে। এর বাইরে ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রায় সব জেলা পর্যায়ে এবং প্রায় তিনশ উপজেলা পর্যায়ের কমিটি আছে। যদিও চলতি বছরের ২৩ জুলাই সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ তুলে একযোগে পদত্যাগ করেন।
এছাড়া জোটে অংশ নেওয়া বামপন্থি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের প্রায় ৪১টি জেলা পর্যায়ের ও ৭০ এর অধিক উপজেলা পর্যায়ের কমিটি আছে। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের কর্মসূচি পালন করতেও দেখা গেছে। তবে গত তিনটি কর্মসূচিতে মোট উপস্থিতির সংখ্যা শতকের ঘরও পার করতে পারেনি। এর বাইরে ১২টি সংগঠনের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটির শুধু নামমাত্র চার-পাঁচ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। বেশিরভাগ সংগঠনের নেই কোনো শাখা কমিটি। বাকি সংগঠনগুলোর আহ্বায়ক-সদস্য সচিব ছাড়া কারও নাম অনেকের অজানা। অতীতে তাদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়নি। এমনকি তাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী আছে কি না তাও জানা যায়নি।
ছাত্রদলের ছাত্র ঐক্যে আলো দেখছে না কেউই
ছাত্রদলের করা ছাত্র ঐক্যকে ভালোভাবে দেখছে না ছাত্রদলের একটি বড় অংশ। ছাত্রদলের কেউ সংগঠনের বর্তমান নেতৃত্বের কোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বললে শোকজ ও বহিষ্কার করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ছাত্রদলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপি নেতারা। ফলে ছাত্রদলের নেতারা গণমাধ্যমে খোলাসা করে কথা বলছেন না। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এরকম কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের।
তারা দাবি করেন, ছাত্র জোট হচ্ছে সেটি আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারিনি। বাইরের মানুষ জানার পর আমরা জানি। আমাদের জানানো হচ্ছে না, রাখা হচ্ছে না। বৈঠকে কী হচ্ছে না হচ্ছে তাও আমরা জানি না। ভালো কয়েকটা সংগঠনকেও রাখা হচ্ছে না। এই জোট নিয়ে আমরা সন্দিহান। বর্তমান নেতৃত্ব তাদের রাজনৈতিক অর্জন দেখানোর জন্য এ জোট করেছে। অন্যথায় তারা সবাইকে নিয়েই ছাত্র ঐক্য করতে পারতো।
বামপন্থি সাত ছাত্র সংগঠন নিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সবশেষ শিক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমাবেশ করেন তারা। এ সংগঠনের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বললে তারাও এ ছাত্র জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত। তারা বলেন, আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানটি মধুর ক্যান্টিনে না হলেও অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে করতে পারলে কার্যকর হতো। তবে এ উদ্যোগের জন্য ছাত্রদলকে অভিনন্দন জানান তারা।
ছাত্র ঐক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি ও গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সোহেল জাগো নিউজকে বলেন, তারা যেহেতু ছাত্র সংগঠন- সেক্ষেত্রে তাদের এ কর্মসূচি ও আত্মপ্রকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, মধুর ক্যান্টিনে হওয়া উচিত ছিল। তারা যদি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলা-মামলা এড়ানোর জন্য করে সেক্ষেত্রে ঠিক আছে। তবে মধুর ক্যান্টিন থেকেই করলে সেটি বেশি কার্যকরী হতো।
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রাগীব নাঈম জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীদের নিয়েই ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা উচিত। মধুর ক্যান্টিন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। দেশের বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা হতো মধুর ক্যান্টিন থেকে। এ জোট সফল হোক না হোক সেটি যদি কোনো মিলনায়তনে না হয়ে মধুর ক্যান্টিন থেকে আসতো তাহলে শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যরকম একটি বার্তা যেতো। আমি জানি না জোটবদ্ধ সংগঠনগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক কার্যক্রম আছে কি না। থাকলে আমার মনে হয় এ জোটের ঘোষণা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকেই আসতো।
ছাত্র ঐক্যের সমন্বয়ক ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদিব জাগো নিউজকে বলেন, যারা যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে আছে তাদের নিয়েই আমরা ছাত্র ঐক্য গঠন করেছি। তবে ঐক্যের এ দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি। সেটি চলবে। কোনো ইসলামী দলকে বঞ্চিত করার যে বিষয়টি সেটি পুরোপুরি সত্য নয়। ছাত্র জমিয়ত নামে একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠন আমাদের জোটে আছে।
ছাত্রদলের এ ছাত্র ঐক্যকে শিক্ষার্থীবিরোধী সন্ত্রসীদের জোট আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই। জোট গঠনের কথা বলা হয়েছে সেটিতে শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জোট ঘোষণার স্থলই প্রমাণ করে বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সাফাই গাওয়ার জন্য, দুর্নীতির সাফাই গাওয়ার জন্য তাদের রাজনৈতিক একটি এক্সটেনশন মাত্র। এটির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পরাজিত করার জন্য তারা এ জোট গঠন করেছে। এটি শিক্ষার্থীদের কোনো জোট নয়।
ক্যাম্পাসে কর্মসূচি দিলে তাদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করতো কি না এমন প্রশ্ন করলে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, যারা সামরিক স্বৈরাচারের সেবা দাস, যুদ্ধাপরাধীদের মুখপাত্র, বর্তমান সময়ে যারা ষড়যন্ত্রকারীদের চলতি বাহক তাদের ছাত্ররাজনীতিতে কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পরিবেশ একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুণ্ণ থাকে সেটি নিয়ে আমরা সচেতন থাকি। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া, শিক্ষার ভালো পরিবেশ দেওয়া, তাদের জন্য ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উপহার দেওয়া সেটি আমাদের কর্মকাণ্ড।
আল সাদী ভূঁইয়া/এসএনআর/এএসএম