বিএনপিতে নোমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী?
আবদুল্লাহ আল নোমান। বিএনপির রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। রাজনীতির বয়স অর্ধশতাব্দীরও বেশি। একসময়ের বামপন্থি রাজনীতিক, আশির দশকে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে যোগ দিয়ে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিতে। দলটির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। বিএনপি থেকেই সংসদ সদস্য হয়েছেন কয়েকবার, পালন করেছেন একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব। এখন দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান।
চট্টগ্রামে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম আবদুল্লাহ আল নোমান। এক সময় চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতি অর্থই ছিল আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্ব। মহানগর-উত্তর-দক্ষিণ প্রায় সব জায়গায় তার নেতৃত্ব ছিল। তার অনুসারীরাই নেতৃত্বের আসনে থাকতেন সবসময়। কেন্দ্রীয়ভাবে শ্রমিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতিও ছিলেন তিনি। তাকে ছাড়া চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি, এক সময় কল্পনাই করা যেত না।
কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলনের চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশে দেখা যায়নি একসময়ের চট্টগ্রামের বিএনপির নিয়ন্ত্রক আবদুল্লাহ আল নোমানকে। এই প্রথম চট্টগ্রামে বিএনপির বড় কোনো কর্মসূচিতে তার অনুপস্থিতি নেতাকর্মী ও বিএনপি সমর্থকদের হতাশ করেছে। নেতাকর্মীরা মনে করেন দলে প্রচণ্ড রকমের অবহেলার শিকার হয়েই তিনি উপস্থিত ছিলেন না। অথচ কেন্দ্র থেকে জেলা, মহানগরের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা ছিলেন, শুধু ছিলেন না চট্টগ্রামে বিএনপির এক সময়ের কাণ্ডারি নোমান।
সমাবেশের দুদিন আগেই চট্টগ্রামে এসে নিজ সংসদীয় আসনে সমাবেশের প্রস্তুতি সভা শেষ করে আবারও তিনি ফিরেছেন ঢাকায়। সমাবেশে কেন নোমান অনুপস্থিত— এ নিয়ে আলোচনা আছে রাজনৈতিক অঙ্গন ও খোদ দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেই।
আরও পড়ুন: ত্যাগী নেতারা দলে মূল্যায়িত হয় না দাবি নোমানের
দলের একাধিক সূত্র জানায়, সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির কোনো পর্যায়ে আবদুল্লাহ আল নোমানকে রাখা হয়নি। যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে প্রস্তুতি কমিটির পক্ষ থেকে তাকে মহাসমাবেশে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। এই ‘উপেক্ষার’কারণে অভিমানী নোমান উপস্থিত হননি সমাবেশে। জানা যায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ফোন করে অনুরোধ জানিয়ে তাকে নিতে পারেননি।
তবে আবদুল্লাহ আল নোমান জানান, শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি সমাবেশে যেতে পারেননি। প্রস্তুতি কমিটিতে না রাখলেও নিজ উদ্যোগে তিনি সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন প্রস্তুতি সভার মাধ্যমে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশের জন্য কেন্দ্র থেকে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে টিম প্রধান করা হয়েছিল ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানকে। আর সমন্বয়কারী ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম।
গত ১০ অক্টোবর আবদুল্লাহ আল নোমান চট্টগ্রামে এসে নিজ সংসদীয় আসন ডবলমুরিং-হালিশহর এলাকায় থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীদের নিয়ে ‘প্রস্তুতি সমাবেশ’ করেন। সেই সমাবেশে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনও অংশ নেন। গণসমাবেশের সমর্থনে প্রস্তুতি সমাবেশ করে রাতেই আবার ঢাকায় ফেরেন ।
আবদুল্লাহ আল নোমানের ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই জানান, দলে নিজেকে ‘উপেক্ষিত’ ভাবছেন বলেই হয়তো তিনি চট্টগ্রামের সমাবেশে উপস্থিত হননি।
আরও পড়ুন: রাজবাড়ী মহিলা দল নেত্রী স্মৃতির জামিন চেম্বারে স্থগিত
বিএনপির বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ব্যবসায়ী সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ১৯৯১ সালে নোমানের হাত ধরেই বিএনপিতে যোগ দেন। নোমানের সমর্থন নিয়েই তিনি বন্দর আসন থেকে তিন দফা সংসদ সদস্য হন। সেই আমীর খসরু দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং নোমান ভাইস চেয়ারম্যান। সাংগঠনিকভাবে খসরুর নিচে অবস্থানকে অসম্মানজনক মনে করেন দলের এই প্রবীণ নেতা নোমান।
বিএনপির সমাবেশে নোমান-ফাইল ছবি
চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরা গ্রামে জন্ম নেওয়া আবদুল্লাহ আল নোমানের বড় ভাই আবদুল্লাহ আল হারুন ছিলেন চট্টগ্রাম ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ষাটের দশকের শুরুতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নোমান যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। মেননপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রজীবন শেষে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ছিলেন। গোপনে ভাসানীপন্থি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত হন। ১৯৭০ সালে তাকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ শেষে আবারও ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর ১৯৮১ সালে যোগ দেন দলটিতে। চট্টগ্রামের রাউজান ও কোতোয়ালি আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি সরকারের মন্ত্রিসভায় খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন।
আরও পড়ুন: তারেক-জোবায়দার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
রাজনৈতিক ঘরানার বাইরেও চট্টগ্রামে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা আছে আশিতে পা দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা আবদুল্লাহ আল নোমানের। দলের হাইকমান্ডের প্রতি অশেষ অভিমানে ‘নীল’হয়ে আছেন। ঘনিষ্ঠজনদের তিনি বলেন, দলের কর্মী হিসেবে আছি, ‘ভাইস চেয়ারম্যান’ পদবি ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। তার সমর্থকরাও সেটি অনুসরণ করছেন। পরিচয় দেন ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী’ হিসেবে।
আবদুল্লাহ আল নোমান বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটিতে ঠাঁই পাননি। তিনি এবং তার দলীয় সমর্থকদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি, কিন্তু পূরণ হয়নি। এ নিয়ে চট্টগ্রামে দলের সভা-সমাবেশে ক্ষোভ-অসন্তোষ, হতাশা প্রকাশ পায়। এতকিছুর পরও তিনি রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। আরও নতুন স্থায়ী কমিটির সদস্যের পদ খালি থাকায় নোমান আশা ছাড়েননি। বরং নতুন করে ‘বিবেচনা’ হলে পুরস্কারও পেতে পারেন এরজন্য অপেক্ষা করছেন। নোমানকেও স্থায়ী কমিটিতে প্রত্যাশী দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থকদের দাবি হচ্ছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় আনার। তাছাড়া অতীতে চট্টগ্রাম থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে অন্তত দুজন নেতা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
সূত্র মতে, আবদুল্লাহ আল নোমান দলের প্রতি ও খালেদা জিয়ার প্রতি অনুগত হলেও ১/১১ সময় তার ভূমিকাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। সেই সময় আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার সংস্কার আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন ছিল বলে মনে করা হয়।
যদিও তিনি সেই সময়টা বাংলাদেশের বাইরে ছিলেন। সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে অবস্থান করলেও জিয়া পরিবারের দুঃসময়ে তিনি ছিলেন না। ওই সময় মান্নান ভূঁইয়া ও সাদেক হোসেন খোকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে যাদের মনে করা হতো নোমান তাদের অন্যতম।
দলের অপর সূত্র জানায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ম্যানেজ করে দলের শীর্ষ পর্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন হাইব্রিড নেতারা। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন ত্যাগী নেতারা। মাঠ কাঁপানো শীর্ষ ও প্রভাবশালী নেতারা এমনটাই মনে করেন।
আরও পড়ুন: পৈতৃক সম্পত্তি বেচে রাজনীতি করি: ফখরুল
তারা বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে থাকা অবস্থায় বিএনপির বড় একটি অংশ অর্থাৎ আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছি। আবদুল্লাহ আল নোমান সেই বঞ্চিতদেরই একজন। তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তের জন্য দলের মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বিএনপির ত্যাগী নেতারা। প্রকৃত রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে হাইব্রিড ও ব্যবসায়ী নেতাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এসব কারণে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা বিএনপিবিমুখ হয়ে পড়েছেন। প্রতিনিয়তই দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে দলীয় শক্তি। এতে হতাশায় রয়েছেন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের কাছে আমরা হেরে যাচ্ছি। দলের ক্ষমতা আজ টাকার কাছে বিক্রি হচ্ছে। হাইব্রিড ও ব্যবসায়ীদের প্রভাবে দলে টিকে থাকাটাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
আবদুল্লাহ আল নোমানের বিষয়ে নিজের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও মন্তব্য করতে চাননি।
কেএইচ/এসএইচএস/এএসএম