ফজলে রাব্বী মিয়ার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবনের অবসান হয়েছে। জাতীয় জীবনে এ মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। সংসদীয় গণতন্ত্রে অসামান্য ভূমিকার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।
শনিবার (বাংলাদেশ সময় ২৩ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের (স্থানীয় সময় ২২ জুলাই) মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ফজলে রাব্বী মিয়া।
তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ মন্ত্রীপরিষদের সদস্য ও বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এই মৃত্যু দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের শূন্যতা। এটি পূরণ হবার নয়।
শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, সংসদ পরিচালনায় মরহুম ফজলে রাব্বী মিয়ার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশে তার অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সংসদের নেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই ফজলে রাব্বী মিয়া আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ’৬২ এর শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ১১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে অসামান্য ভূমিকার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আামির হোসেন আমু বলেন, গণতান্ত্রিক সংসদীয় ধারার রাজনীতির বিকাশে মরহুম ফজলে রাব্বী মিয়ার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই মৃত্যু জাতীয় জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি।
জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, রাজনীতিবিদ ও মানুষ হিসেবে ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া ছিলেন অনন্য। তার সংসদীয় জ্ঞানের গভীরতা প্রগাঢ়। তার অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অনুসরণযোগ্য। এমন একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের শূন্যতা পূরণ হবার নয়।
জন্ম ও বেড়ে উঠা:
ফজলে রাব্বী মিয়া ১৯৪৬ সালের ১৫ এপ্রিল গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার গটিয়া গ্রামে জন্ম নেন। তার পিতার নাম ফয়জার রহমান ও মাতার নাম হামিদুন নেছা। ১৯৬১ সালে তিনি গাইবান্ধা কলেজে ভর্তি হন। তিনি বিএ ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল সনদ লাভ করেন। এরপর ১৯৮৮ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হন।
বর্ণাঢ্য সেই রাজনৈতিক জীবন:
১৯৫৮ সালে রাজনীতিতে আসেন ফজলে রাব্বী মিয়া। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে ‘মার্শাল ল’ চালু করেছিলেন। সে সময় ফজলে রাব্বীর চাচা নিজ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। চাচার মাধ্যমে তিনি ‘মার্শাল ল’ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পরেন। ১৯৬২-৬৩ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধেও তিনি আন্দোলন করেছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ফজলে রাব্বী মিয়া মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ১১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলতে তিনি কাজ করেছেন।
ফজলে রাব্বী মিয়া ১৯৮৬ সালের তৃতীয়, ১৯৮৮ সালের চতুর্থ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এরপর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হন। কিন্তু ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৯ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দশম সংসদ থেকে তিনি আমৃত্যু ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০২১ সালের জুনে ফজলে রাব্বী মিয়ার পেটে টিউমার অপারেশন হয়। তবে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য আগস্টে তাকে ভারত নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার জীবনাবসান হয়।
তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান হলো। এর ফলে জাতীয় রাজনীতিতে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হলো।
এসইউজে/এমপি/এএসএম