ক্ষমতায় টানা ১৪ বছর, ১৪ দলের ২৩ দফা বাস্তবায়ন কতদূর?
১৮ বছর হয়ে গেছে ১৪ দলীয় জোট গঠনের। পরিপক্ব এই জোটের ক্ষমতার মেয়াদও টানা ১৪ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এই জোট গঠনের মূল লক্ষ্য ২৩ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেই সন্তোষজনক অগ্রগতি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, কালাকানুন প্রত্যাহার, বিভিন্ন মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ বেশকিছু দফা বাস্তবায়ন হলেও জনজীবনে পরিবর্তনের ধারাগুলো খুব একটা বাস্তবায়ন হয়নি।
এজন্য শরিকরা দুষছেন বড় দল আওয়ামী লীগকে। তারা বলছেন, বড় দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অভাব এখানে বড় ব্যাপার। পাশাপাশি আমাদের দেশের দুর্ভাগ্যজনক একটা রীতি; আমরা যা বলি তা করি না।
তবে বড় দল আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ‘ক্ষমতায় থাকলেও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কারণে শতভাগ লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি একথা সত্য। তবে তাদের লক্ষ্য স্থির, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন।’
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাম দলগুলোর সমন্বয়ে জোট গঠনের প্রচেষ্টা শুরু হয় ২০০৩ সালের শেষ দিকে। সে সময় কিছুদিন যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালনের পর ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ২৩ দফা লক্ষ্য ও কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ, ১১ দলীয় জোট, জাসদ ও ন্যাপকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হয়। যদিও গঠনের সময় থেকেই এই জোটে এসেও আসেননি বা বেরিয়েও গেছেন অনেকে।
এই জোটের ২৩ দফার অগ্রগতি নিয়ে একাধিক নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচন এলে বেড়ে যায় জোটের কদর। এমনকি বাড়ে পরিধিও। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হলে নিষ্প্রাণ বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় জোট। অবহেলা অযত্নে অভিমানে দূরে সরে যান অনেকে। এমনকি জোটের কর্মসূচির প্রতিও কারও নজর থাকে না। তবে এরই মধ্যে জোটের ২৩ দফা কর্মসূচির আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিটা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।’
এ বিষয়ে জোটের শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২৩ দফার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। অধিকাংশ হয়নি। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্যজনক একটা রীতি; আমরা যা বলি তা করি না। এখানে প্রধান দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অভাব তো আছেই।’
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, কিছু কালাকানুন প্রত্যাহার, বিভিন্ন মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার; এগুলো হয়েছে। কিন্তু জনজীবনে পরিবর্তনের যে ধারাগুলো ছিল, সেগুলো খুব একটা হয়নি।’
জোট শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু জাগো নিউজকে বলেন, অনেক কিছুরই অগ্রগতি হয়েছে। তবে বৈষম্য দূর করা বা সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করার ব্যাপারে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেগুলো কার্যকর হয়নি।
তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বা সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা থেকে পুরোপুরি বের করে নিয়ে আসার জন্য ২৩ দফার আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ এখনও নেওয়া হয়নি। অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে শ্রমিক-গরিবদের বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে, কমতি আছে।
এ বিষয়ে ১৪ দলের আরেক শরিক বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘জোটের কর্মসূচি বাস্তবায়নে আংশিক অগ্রগতি হয়েছে। বাকিটা বাস্তবায়নে আমরা আন্দোলন-সংগ্রামে আছি। চেষ্টা করছি বাস্তবায়ন করার জন্য।’
এ বিষয়ে ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু গণমাধ্যমকে এড়িয়ে যান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে কথা বলার সময় নয় এখন।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ১৪ দলীয় জোট একটি আদর্শিক রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। শুরুতে ২৩ দফার ভিত্তিতে এই জোটের যাত্রা শুরু। ২৩ দফার অধিকাংশ দফা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। ক্ষমতায় থাকলেও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কারণে শতভাগ লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি একথা সত্য।
তিনি বলেন, যে কোনো কঠিন পরীক্ষায় শতভাগ নম্বর পেতে যেমন কঠিন অধ্যবসায় প্রয়োজন, তেমনি সময়ের প্রয়োজন। আমাদের লক্ষ্য স্থির, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের নেতা শেখ হাসিনা যা অঙ্গীকার করেন, তা বাস্তবায়ন করেন।
১৪ দলের ২৩ দফা
১. ১৫ জুলাই ২০০৫ ঘোষিত অভিন্ন রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারসহ অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে। প্রতিষ্ঠিত করা হবে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সরকার। সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।
২. দেশকে উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের হাত থেকে রক্ষা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর, ইতিহাস বিকৃতি রোধ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা হবে। উদীচী থেকে শুরু করে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সমাবেশসহ এ যাবৎকালের সব গ্রেনেড হামলা, বোমাবাজি, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, হত্যা প্রচেষ্টা এবং সশস্ত্র জঙ্গিবাদের তৎপরতার জন্য দায়ী ব্যক্তি, গোষ্ঠীকে চিহ্নিত ও গ্রেফতার, বিচার ও উৎখাত করা হবে।
৩. রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রাধান্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দলীয়করণ বন্ধ, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ, পদোন্নতি দান, অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বাসন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে।
৪. জাতীয় সংসদকে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে কার্যকর করা হবে। এক বছরের মধ্যে জেলা ও উপজেলাসহ সর্বস্তরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে।
৫. সন্ত্রাস বন্ধ, সন্ত্রাসী ও গডফাদারকে চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার ও বিচার করা হবে এবং তাদের রাজনৈতিক দলে গ্রহণ বা মনোনয়ন দেওয়া যাবে না। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নমুক্ত সুস্থ রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করা হবে।
৬. রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
৭. দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।
৮. চাল-ডাল-তেলসহ দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ফিরিয়ে আনা হবে। ‘মূল নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গঠন, চাঁদাবাজি বন্ধ, ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠা, গরিবদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু ও জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
৯. দারিদ্র্য নিরসনে বহুমুখী জাতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে প্রত্যেক বাজেটে বরাদ্দ নির্দিষ্ট থাকবে।
১০. সব কর্মক্ষম নাগরিককে নিবন্ধন করা হবে। প্রত্যেক পরিবারের একজন কর্মক্ষম যুবককে কর্মসংস্থানের জন্য ‘এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম’সহ বেকারত্ব দূর করার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
১১. কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস, ভর্তুকি প্রদান ও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। ক্ষেতমজুর ও কৃষি শ্রমিকদের কাজ ও মজুরির ব্যবস্থা করা, কৃষি পুনর্বাসন ও ভূমি সংস্কার করা হবে।
১২. বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যথোচিত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা প্রদান করা হবে।
১৩. ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতি পুনর্বহাল করে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে। নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নির্বাচনসহ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে।
১৪. সব পেশাজীবীদের ন্যায়সঙ্গত ২১ দফা দাবি বাস্তবায়ন করা হবে।
১৫. একমুখী শিক্ষাক্রম বাতিল করে একই পদ্ধতির বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হবে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দলীয়করণ বন্ধ করা হবে।
১৬. সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টার চালু, আর্সেনিক দূষণ ও এইচআইভিসহ সংক্রামকব্যাধি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা হবে।
১৭. সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান, অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা হবে। অপসংস্কৃতি রোধ এবং অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে উৎসাহিত করা হবে।
১৮. পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন বাতিল করা হবে।
১৯. বাংলাদেশের গ্যাস, কয়লাসহ খনিজ সম্পদের জাতীয় স্বার্থে সর্বোচ্চ ব্যবহার, স্বচ্ছ বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বন্দর ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়ন এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরকে এশিয়ার বন্দরে পরিণত করা হবে।
২০. আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন, পানি ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনে আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে বিরাজমান সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
২১. জনগণের অংশগ্রহণ ও আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করা হবে।
২২. বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস ও আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ ও সীমান্তে শান্তিসহ দৃঢ়ভাবে আঞ্চলিক সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করা হবে।
২৩. ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতির আলোকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা হবে।
এসইউজে/এসএইচএস/এএসএম