‘দ্বিধায়’ আটকে বিএনপির বৃহত্তর ঐক্য গঠন
সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গঠনে বিএনপি অনেক দিন ধরে কাজ করলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। নানা কারণে, নানা সমীকরণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তাদের বৃহত্তর ঐক্য গঠন প্রক্রিয়া। জামায়াত প্রশ্ন এবং বুদ্ধিজীবী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বাড়তে থাকা দূরত্ব বিএনপির বৃহত্তর ঐক্য গঠনকে সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত করছে। দুটি ক্ষেত্রেই হাইকমান্ডের ‘দ্বিধা’ গোপন থাকছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আগের দুই জোট ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মিত্রদের পাশাপাশি সমমনা বামদল ও ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করার কারণে বামদলগুলো বিএনপির এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এর মধ্যে আবার ঐক্যফ্রন্টের সংগঠক ও বুদ্ধিজীবী ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে দলটির নেতাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যা বৃহত্তর ঐক্য গঠন প্রক্রিয়াকে আটকে রেখেছে পরিকল্পনাতেই।
নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে আগামী ২৮ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছে বামদলগুলোর জোট বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। গত ১৩ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান ওই হরতালে সমর্থনের ঘোষণা দেন। কিন্তু ফ্রন্টের নেতা ও সিপিবির সভাপতি মো. শাহ আলম এই সমর্থন প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, হরতাল আমরা বামপন্থিরা ডেকেছি। বিএনপির সমর্থন তো আমরা চাইনি। বিএনপির রাজনীতি বিএনপি করুক। বিএনপির কোমরে জোর থাকলে আলাদাভাবে করুক। আমরা হরতালে তাদের সমর্থন চাইনি।
শাহ আলমের এই বক্তব্যেই বিএনপির প্রতি বামদলগুলোর মনোভাব স্পষ্ট হয়ে যায়।
অন্যদিকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতৃত্বের ক্রমাগত সমালোচনা করতে থাকায় তার প্রতি রুষ্ট হতে থাকেন নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় জাফরুল্লাহকে বিএনপি বা তাদের সহযোগী সংগঠনের অনুষ্ঠানে তোপের মুখেও পড়তে হয়। সে কারণে সম্প্রতি বিএনপি ও তাদের সমমনা সংগঠনের কোনো কর্মসূচিতে তাকে দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু এই দূরত্ব বিএনপিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন অনেকে। তারা বলছেন, বাম রাজনৈতিক বলয়ে জাফরুল্লাহর যে প্রভাব রয়েছে, তা বিএনপির অনেক নেতার নেই। জাফরুল্লাহর সঙ্গে বোঝাপড়াটা ভালো থাকলে বামদলগুলোর সঙ্গে বিএনপির আলোচনাও সহজ হতে পারতো। তার সঙ্গে দূরত্ব বিএনপিকে এক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখছে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আছে বিএনপির জোট মিত্রদের মধ্যেও। গত ২ মার্চ জেএসডির এক আলোচনা সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আওয়ামী লীগ চলে গেলো, ভোট হলে আপনারা ক্ষমতায় আসবেন? লড়াই যখন করছি, সেই লড়াইয়ে জনগণের অধিকার যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে ডা. জাফরুল্লাহর পরামর্শ নিতে হবে (বিএনপিকে)।
দলীয় সূত্র বলছে, বৃহত্তর ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত পুরোনো মিত্র ছাড়া কারও সঙ্গেই বিএনপির আলোচনা চূড়ান্ত হয়নি।
ঐক্য প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে তিন সদস্যবিশিষ্ট উচ্চপর্যায়ের দুটি কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। একটি কমিটির নেতৃত্বে আছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার সঙ্গে থাকবেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান ও নজরুল ইসলাম খান। এ কমিটি ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করবে।
অন্য কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তার সঙ্গে আছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। এ কমিটি বাম ও ইসলামী দলসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে।
সূত্র মতে, ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আপাতত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে না বিএনপি। সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বৃহত্তর ঐক্য ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতবিনিময় সভা না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৃহত্তর ঐক্য ইস্যুতে বামসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপি ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছে। তারা জামায়াত থাকলে ঐক্যে আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তবে জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিএনপি।
বিএনপির অন্য একটি সূত্র জানায়, বৃহত্তর জোট গঠনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চলছিল। তবে তা হচ্ছিল না। এবারও কতটুকু হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ বিএনপিকে বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে হলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে যেমন সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে, তেমনি জামায়াতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হবে। বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে হলে বিএনপিকে পরিষ্কার অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জামায়াতকে না রাখার ব্যাপারে অনেকে একমত হলেও সরকার তাদের কাছে টানতে পারে সেটাও ভাবতে হচ্ছে। তাই এখনই জামায়াত নিয়ে সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ কম। পরিস্থিতি বলে দেবে। সার্বিক বিষয় নিয়ে স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার কাজ চলছে। আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করছি। আমাদের কাজ চলছে।
কবে নাগাদ এই ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কাজ করছি, চেষ্টা করছি, কবে নাগাদ এই প্রক্রিয়া শেষ হবে সেটা এখন বলা যাচ্ছে না।
জামায়াত সঙ্গে থাকলে কেউ কেউ বৃহত্তর ঐক্যের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে না, এমন প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বেগম সেলিমা বলেন, কে কী বলছে সেটা আমরা বলতে চাই না, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমাদের নির্বাচনী জোট। আমরা জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। কেউ যদি না এসে যুগপৎ আন্দোলন করতে চায়, করবে। আমরা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশ রক্ষায় সরকারকে হটানোর কোনো বিকল্প নেই। সব রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আলোচনা চলছে, একজোট সম্ভব না হলেও যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হবে। কাজটা কঠিন হলেও আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে হটানো হবে।
কেএইচ/এইচএ/এমএস