ডাকসু নির্বাচন বন্ধ রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই
রাশেদ খান মেনন। সংসদ সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সাবেক ছাত্রনেতা ও মন্ত্রী। জন্ম ফরিদপুর শহরে। পড়াশোনা ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে আসেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে খ্যাতি লাভ করেন। নেতৃত্ব দেন ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে, অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।
ঢাবির শতবর্ষপূর্তি হয়েছে এ বছরের ১ জুলাই। তবে করোনা মহামারির কারণে সেসময় শতবর্ষ উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান করা যায়নি। ওই উদযাপন শুরু হয়েছে গত বুধবার (১ ডিসেম্বর)। শেষ হবে ১৬ ডিসেম্বর। এ উপলক্ষে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আল সাদী ভূঁইয়া।
জাগো নিউজ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের সময়কার ছাত্ররাজনীতি কেমন ছিল?
রাশেদ খান মেনন: আমরা যখন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি তখন সামরিক সরকার ছিল। তখন ছাত্র রাজনীতি করাই নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন, হল সংসদের নির্বাচনগুলো হতো। এগুলো হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। পরে ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের পর যখন সামরিক শাসন উঠে গেল, তখন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন নিজ নামে সংগঠিত হলো। তখনকার ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, প্রতিযোগিতা ছিল। ছোটখাট মারামারি হয়েছে। কিন্তু বৈরী সম্পর্ক ছিল না।
পরে যখন মোনায়েম খান গভর্নর হয়ে এলো, তখন মোনায়েম খান সেনাশাসক আইয়ুব খান সমর্থক ছাত্র সংগঠন এনএসএফের কর্মীদের গুন্ডা বাহিনীতে পরিণত করলো। তারা ছাত্র আন্দোলনের পরিবেশটা বিষাক্ত করলো। কিন্তু কখনোই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বিরোধ ছিল না। তখনকার ছাত্রনেতারা যে দলেরই হোক, অন্য সংগঠনের নেতাদের সম্মান করতো, শ্রদ্ধা করতো। এনএসএফ সামরিক বাহিনী হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির পরিবেশ ভালো ছিল।
জাগো নিউজ: বর্তমান ছাত্ররাজনীতি ও ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহাবস্থান নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ...
রাশেদ খান মেনন: সহাবস্থান শব্দটা আগে কখনো শুনিনি। কেন ক্যাম্পাসে সহাবস্থান থাকবে না? আমরা মারামারি করেছি, পরে গিয়ে এক সঙ্গে চাও খেয়েছি। এতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আমাদের ঝামেলা হয়েছে, পুলিশ এসে ধাওয়া করেছে। পরে আবার মীমাংসা করে নিয়েছি। কিন্তু হল থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া, সিট দখল করা এগুলো ছিল না।
জাগো নিউজ: বর্তমান ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রমগুলো কীভাবে দেখেন?
রাশেদ খান মেনন: এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলো তো ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি করে না। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুগামী হিসেবে রাজনীতি করে। আমি এদের বলি দলদাস। দলের অনুগত। যেহেতু বাইরে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একটু বিরূপ সম্পর্ক রয়েছে, তার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। একদল আরেকদলকে সহ্য করতে পারে না। একদল ক্ষমতায় এলে আরেকদলকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়। এটাকে ছাত্ররাজনীতি বলি না। এটাকে বলি দলীয় আনুগত্যের রাজনীতি।
জাগো নিউজ: নিয়মিত ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন না হওয়া প্রসঙ্গে কী বলবেন?
রাশেদ খান মেনন: যখন সামরিক শাসন ছিল, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি ছিল, সে সময়েও ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। যখন জিয়ার সামরিক শাসন ছিল তখনো ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। যখন এরশাদের সামরিক শাসন ছিল তখনো হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। যখনই ’৯০-এর পরে আমরা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় প্রবেশ করলাম এবং রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেল, তখনই ডাকসুর মতো নির্বাচনগুলো বন্ধ হয়ে গেল। বছরের পর বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ।
সবশেষে ২০১৯ সালে একটি ডাকসু নির্বাচন হলো, তাও প্রশ্নবিদ্ধ! তারপরও একটি নির্বাচন হয়েছিল। তবে সেটিও নির্বাচন না হওয়ার চেয়েও ভালো ছিল। কোভিডের কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
জাগো নিউজ: শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে প্রত্যাশা...
রাশেদ খান মেনন: আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক উন্নত ছিল। যেসব শিক্ষক আমাদের পড়িয়েছেন তারা বাংলাদেশ ও বিশ্বে উভয়ক্ষেত্রে যশস্বী ছিলেন। এখনো যারা পাঠদান ও গবেষণার ক্ষেত্রে আছেন, তারা বিশ্বের শীর্ষস্থানে আছেন। ফলে জাতি তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এই যে শিক্ষার পরিবেশ, সেটি ফিরিয়ে আনা দরকার। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা দরকার। সবচেয়ে দুঃখের জায়গা হলো বিশ্বের র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো জায়গা নেই। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্সফোর্ড অব দি ইস্ট বলা হতো, সে নাম এখন মলিন হয়ে গেছে। দেশের সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আমরা আরও বেশি শিক্ষা, দীক্ষা, গবেষণা, জ্ঞানের পরিধি আশা করি এবং এটা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
জাগো নিউজ: এখনকার শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আপনার মতামত কী?
রাশেদ খান মেনন: এখনকার শিক্ষকদের রাজনীতিও ছাত্রদের রাজনীতির মতো জাতীয় রাজনীতির অনুগামী। এর বাইরে কিছু নয়। এর সঙ্গে সাধারণ শিক্ষকদের স্বার্থ বা অধিকার কতখানি জড়িত সেটা বলতে হবে। কিন্তু আমরা দেখি তারা (শিক্ষক নেতারা) দেশের রাজনৈতিক দলের অনুগামী হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এটা শিক্ষক রাজনীতি নয়।
এমএইচআর/এইচএ/জিকেএস