ঢাকার রাজনীতির এক মহানায়কের নাম মোহাম্মদ হানিফ
১৯৫৪ সালের নির্বাচন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অভাবনীয় সাফল্য। আর এই সাফল্যই কাল হয়ে দেখা দেয় তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে। রোষানলে পড়েন সরকারের। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয় এবং গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে মুজিব পরিবারকে মন্ত্রীপাড়ার বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দেওয়া হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেন পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের হানিফ পরিবারে। এভাবেই মুজিব পরিবারের সঙ্গে হানিফ পরিবারের মিলে যাওয়া। যা আজও অটুট রয়েছে। যেন একে অপরের ভরসাস্থল।
ঢাকার অবিসংবাদিত নেতা মোহাম্মদ হানিফের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (২৮ নভেম্বর-শনিবার)। ২০০৪ সালে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি। দীর্ঘ সময় শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বয়ে বেড়ানো আওয়ামী লীগের নিবেদিত এই নেতা ২০০৬ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন।
মোহাম্মদ হানিফের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ এপ্রিল, পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। বাবা আবদুল আজিজ এবং মা মুন্নি বেগমের পরিবারে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট ছেলে। এক ছেলে এবং দুই মেয়ের জনক ছিলেন তিনি। হানিফ যৌবনের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। দলীয় রাজনীতি করলেও উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছেই অধিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল তার।
১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) এইচএসসি ও বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন, যার জন্য তিনি সব সময় চাইতেন মোহাম্মদ হানিফ যেন সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন। এ কারণেই ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। একান্ত সচিব থাকাকালীন ছয় দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয় দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন সেই সময়ের তরুণ এই নেতা। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচনসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সব আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলনে তিনি রাজপথে থেকে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া ঢাকা-১২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে হুইপের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সংগ্রামী জীবনে ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টানা ৩০ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ’৯০-এর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন মোহাম্মদ হানিফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়া মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। রাজধানীর আধুনিকায়নে সফল এই মেয়রের নাম আজও মানুষ কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করেন। ১৯৯৬-এর মার্চের শেষ সপ্তাহে হানিফের নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করা হয়, যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে।
ঢাকার গণমানুষের এই নেতা সারাজীবন রাজপথে থেকেই আন্দোলন করেছেন। ২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করেন। ধারণা করা হয়, এই মানব ঢালই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সেদিন রক্ষা করে। তবে শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও গুরুতর আহত হন হানিফ। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্রিন্টার ঢুকে পড়ে।
২০০৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতি হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর মাথায় বিদ্ধ স্প্রিন্টারের কারণে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ২৮ নভেম্বর ২০০৬ দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মোহাম্মদ হানিফ। চির অবসান ঘটে সফল এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের।
বাবার কাছ থেকে পাওয়া রাজনৈতিক দীক্ষা নিয়ে হানিফের একমাত্র পুত্র সাঈদ খোকন আজ ঢাকার মেয়র। হানিফের রাজনৈতিক উত্তরসূরি সাঈদ খোকন যেন বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনার হাত ধরেই এগিয়ে চলছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশবাসীর দোয়া কামনা করেছেন। এ উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন সমূহ, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
এএসএস/আরএস