ভিডিও EN
  1. Home/
  2. রাজনীতি

জোট নিয়ে জটে বিএনপি

খালিদ হোসেন | প্রকাশিত: ০৮:৫১ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। আর এ সময়ে জোট সরকারের ‘ভুল রাষ্ট্র পরিচালনার কারণেই’ মূলত ১/১১ ঘটনা ঘটে। তার পর থেকে আর ক্ষমতার মুখ দেখেনি তারা। বরং এই সময়ের মাঝে নানা কারণে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি তাদের অনেক পরিক্ষিত বন্ধুদের হারিয়েছে। এমন অবস্থায় নতুন বন্ধু খুঁজতে গিয়ে নানা জোটের জটে আটকে পড়েছে দলটি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের ভরাডুবির পর বিএনপিতে যখন এক ধরনের হতাশা কাজ করছিল তখন হতাশা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে জোট সম্প্রসারণের মাধ্যমে গঠিত হয় ১৮ দলীয় জোট। যেখানে অভিমানে থাকা একসময়ের বিএনপি নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রমের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, একসময় বিএনপি যাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল তাদের অন্যতম শফিকুল গানি স্বপনের জেষ্ঠ্যপুত্র জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা, শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি তাদের রাগ অভিমান ভুলে সেই জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেইসঙ্গে তার সঙ্গে যুক্ত হয় ১/১১ সময় প্রতিষ্ঠিত মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি।

দীর্ঘ সময় এই জোট একসঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে। এমন কী নানা লোভ-লালসা-ভয়কে উপেক্ষা করে ২০১৪ সালের নির্বাচনও বর্জন করে জোট শরীকরা। এরই মধ্যে কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (একাংশ) ও সাম্যবাদী দল (একাংশ) ১৮ দলীয় জোটে যোগ দিলে এই জোট ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়। কিন্তু, বিএনপির ভুল রাজনীতি ও একতরফা নানা সিদ্ধান্তের কারণে অনেকেই সেই জোট ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আবার বিএনপিও তার সামরিক শাসকের চরিত্রের মতো করে জোট ত্যাগ করা দলগুলোর তৃতীয়, চতুর্থ বা কোনো সারিরই নয় এমন লোকদের দিয়ে নতুন দল গঠন করে জোটে ভিড়িয়ে সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে না যাওয়া বিএনপির জন্য ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিএনপির মহাসচিব ও এনপিপি চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলুর মধ্যে মতবিরোধ ঘটে। এর জেরে বিএনপি তাকে জোট থেকে বের করে দেয়ার লক্ষে তার মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে নতুন এনপিপি তৈরি করে। সে সময় শেখ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ (ভাসানী) জোট ত্যাগ করলে কল্যাণ পার্টির এক জেলা পর্যায়ের নেতাকে দিয়ে আরেকটি ন্যাপ ভাসানী তৈরি করা হয়। একই সময় জোট ত্যাগ করে বিএনপির দীর্ঘ দিনের বন্ধু ইসলামী ঐক্যজোট। সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তাদের পৃষ্টপোষকতায় তৈরি হয় নতুন ইসলামী ঐক্যজোট। এভাবেই কোনো দল জোট থেকে বের হয়ে গেলে বিএনপি সেই দলের কিছু নেতাকে নিয়ে নতুন দল গড়ে জোটের সদস্য সংখ্যা ঠিক রাখে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোটকে পাশ কাটিয়ে ও গুরুত্বহীন করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গঠিত হলে আবারও মতবিরোধ তৈরি হয়। এর জেরে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ ও খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন এনডিপি। এ ক্ষেত্রেও বিএনপি একইভাবে ওই দুই দলের বিতর্কিতদের নিয়ে নতুন দুটি দলের জন্ম দেয়। আর নতুন করে জোটে অর্ন্তভুক্ত করে অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় দল ও রিতা রহমানের নেতৃত্বাধীন বিপিপি। পরে উপ-নির্বাচনের মনোনয়ন প্রাপ্তির শর্তে রিতা রহমান তার দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেন।

এদিকে সেই নির্বাচনের পর শপথ গ্রহণকে কেন্দ্র করে আবারও মতবিরোধ ঘটলে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুর ছেলে ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি। এছাড়া ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএনপির দ্বিতীয় জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ ও আবদুল মালেক রতনের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি’র একাংশ।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি তার জোটকে কার্যকর ও বড় করতে বাম ধারার সরকারবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠনের লক্ষে কাজ শুরু করে। কিন্তু, এই জোট গঠনে মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বিএনপির দীর্ঘ সময়ের আরেক বন্ধু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তখন জামায়াতকে বাদ রেখে নতুন জোট করার লক্ষে দলের মধ্যে আলোচনা শুরু হলেও কার্যত তা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি।

বরং জোটের মধ্যে কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদ বীর বিক্রমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় জাতীয় মুক্তি মঞ্চ। আর এই মুক্তি মঞ্চকে কেন্দ্র করে বিএনপির পরোক্ষ পৃষ্টপোষকতায় এলডিপি ও জাগপা বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়ে। এর জেরে কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান দল ত্যাগ করেন।

গত এক বছরে ২০ দলীয় জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এমনকি সরকারের ব্যর্থতা নিয়েও এক সূরে কোনো কথা বলতে পারেনি তারা। বরং জোটের অস্তিত্ব আজ প্রশ্নবিদ্ধ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাসানী অনুসারী পরিষদ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরুকে নিয়ে আলাদাভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে কাজ করে যাচ্ছে।

সবকিছু মিলিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জোট রাজনীতিতে বিএনপি তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এমনকি তাদের সঙ্গে যারা রয়েছেন তাদের কাছেও তাদের বিশ্বাসের যায়গাটা খুবই দুর্বল। অন্যদিকে জামায়াতকে নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা বিএনপিকে বাম দলগুলোর কাছেও ভিড়তে বাধাগ্রস্থ করছে।

রাজনৈতিক জোট নিয়ে বিএনপি যে জটে পড়েছে তাতে সরকার অনেকটাই বাধাহীনভাবে দেশ পরিচালনা করছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণে বিএনপিকে নতুন করে ভাবতে হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এটি করতে ব্যর্থ হলে জোট রাজনীতির জট থেকে বিএনপি বেরিয়ে আসতে পারবে না।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই বিএনপি জোটের পরিসর আরও বৃহত্তর করার চিন্তা-ভাবনা করছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণের চিন্তা-ভাবনা চলছে। এ ধরনের স্বৈরাচারকে হটাতে হলে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। সেটা কী ফরম্যাটে হবে তা সময়ের ব্যাপার।’

তিনি আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, নিরপেক্ষ নির্বাচন ইত্যাদি বলতে গেলে একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। আমরা চার্টার তৈরি করব। সেখানে মিনিমাম কিছু দফা একসঙ্গে থাকবে। এর আগে ২০ দল, ঐক্যফ্রন্ট, বামদলসহ অন্য ছোট-বড় যেসব দল আছে, তাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করব। একই ফর্মুলায় যারা আসবে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা হবে। এ ব্যাপারে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা আছে। একই প্লাটফর্মে এসে আন্দোলন করা হয়, আবার যুগপৎ করা যায়।’

কেএইচ/এমআরআর/জেআইএম