এক জেনারেলের পতনে আরেক জেনারেলের উত্থান
কর্মের ফল দিয়েই যেন শেষ পরিণতি। রাজনীতির ক্ষেত্রে এ ফল একটু বেশিই প্রমাণিত। ঠিক বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাই। রক্তের সিঁড়ি মাড়িয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। আবার রক্তের সিঁড়িতেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সিংহাসন।
এমন রক্তপথ ধরেই আরেক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উত্থান। এক জেনারেলের পতনের মধ্য দিয়ে আরেক জেনারেলের ক্ষমতা দখল।
বাংলাদেশে দুটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব মেলানো ভার। যদিও দুটি হত্যাকাণ্ডই সামরিক ক্যুর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন উচ্চভিলাষী সেনা অফিসাররা। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যের অনেক হিসাব এখনও আড়ালে।
আরও পড়ুন> এইচ এম এরশাদ আর নেই
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর লাভবানদের মধ্যে প্রধানতম হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং ৩ নভেম্বর জেলহত্যা কাণ্ডে জিয়াউর রহমানের নাম সরাসরি উচ্চারিত হয়নি বটে, তবে তার ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান বিশ্লেষক মহল। বিশেষ করে সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা লোভের বিলাসিতা অনেকটাই প্রমাণিত। যে হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণায় জিয়াউর রহমানকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ বলেছেন খোদ আদালত।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে হটিয়ে মসনদে বসেছিলেন জিয়াউর রহমান। তবে যে পথে এসেছিলেন, সেই পথেই বিদায় নিতে হয়েছে এই প্রধান সামরিক প্রশাসককে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার মতো জিয়া হত্যার নেপথ্যের অনেক ঘটনাও আড়ালে। ১৯৮১ সালে ৩১ মে জিয়া যখন নিহত হন, তখন সেনাপ্রধান ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
জিয়া হত্যার পর কী ভূমিকা ছিল এরশাদের? মিলিয়ন ডলারের এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। বিশেষ করে জিয়া হত্যার পরপরই ১৯৮১ এর ১ জুন মঞ্জুর হত্যার মধ্য দিয়ে সে প্রশ্নের উত্তর আরও গুরুত্ব পায়। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর ছিলেন চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর জিওসি। সঙ্গত কারণে, জিয়া হত্যার দায় তার ওপরও বর্তায়।
আরও পড়ুন> যেভাবে রাজনীতিতে টিকে যান জেনারেল এরশাদ
কিন্তু মঞ্জুরকে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। উগ্র সেনা সদস্যরা চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় আটক থাকা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে হত্যা করেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, জিয়া হত্যার প্রতিশোধের আড়ালে মূল ঘটনা এবং প্রমাণ ধামাচাপা দিতেই মঞ্জুরকে সেনা সদস্যদের হাতে তুলে দেয়া হয়। যার পেছনে সেনাপ্রধান এরশাদের নামও জড়িত।
সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজের লেখা, ‘মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড : নেপথ্য কাহিনির দ্বিতীয় পর্ব-১’ শিরোনামে একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয় (২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল, প্রথম আলো)।
লরেন্স লিফশুলৎজ সে সময় ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের (হংকং) দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। ওই লেখার একাংশে তিনি উল্লেখ করেন, ‘এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ও আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়া উভয়েই ঢাকায় উত্তপ্ত বৈঠকে রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে অনুরোধ করেন, মঞ্জুরকে যেন সেনা হেফাজতে তুলে দেয়া না হয়। এই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পৃথক জবানবন্দি থেকে দেখা যায়, তারা উভয়েই আশঙ্কা করছিলেন যে, মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে দেয়া হলে তার জীবন হুমকির মুখে পড়বে। ওই বৈঠকের সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট হাটহাজারী থেকে মঞ্জুরকে তাদের হেফাজতে নেয়ার জন্য পথে বেরিয়ে এসেছে।
বঙ্গভবনে বৈঠক চলাকালে সেনাবাহিনীর ইউনিটটি হাটহাজারী থানায় একতরফাভাবে প্রবেশ করে এবং মঞ্জুরকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দাবি জানায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এ সময় উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পুলিশ সেনাবাহিনীর উগ্রতাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে নিরাপত্তার স্বার্থে মঞ্জুরকে কেন বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে রাখা উচিত, তা নিয়ে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা আইজিপি কিবরিয়া তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদের সঙ্গে তর্ক করছিলেন।’
এ অভিযোগের ভিত্তিতেই মঞ্জুর হত্যার আসামি করা হয় এরশাদকে। এই মামলাকে কেন্দ্র করেই এরশাদ তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহৃত হন রাজনীতির হিসাব-নিকেশে। জিয়া নিহত হওয়ার পর এরশাদ বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে সেনাবাহিনীকে আয়ত্তে রাখে। তাৎক্ষণিক সামরিক অভিযান পরিচালনা না করা, আবার বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা সবই ছিল এরশাদের ক্ষমতা লাভের কৌশল। অন্যদিকে জিয়ার শাসনামালের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিরও আনুকূল্য পেতে সময়ের অপেক্ষা করেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যেদিন সামরিক শাসন জারি করেন, সেদিন আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলও উল্লাস প্রকাশ করেছিল!
এএসএস/এমআরএম/পিআর