যেভাবে এরশাদের পতন
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করতেন ২৯ বছর ধরে তুখোড় খেলোয়াড় হিসেবে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো এ স্বৈরশাসক।
কী হয়েছিল ৬ ডিসেম্বরে? এরশাদের মৃত্যুর পর দিনটিকে নিয়ে নতুন করে সবার মধ্যে বেশ আগ্রহ দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ দিনটি ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’, বিএনপি ‘গণতন্ত্র দিবস’ এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলগুলো দিনটি ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবেও পালন করে।
আরও পড়ুন > এইচ এম এরশাদ আর নেই
১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর এরশাদের পেটোয়া বাহিনী ডা. শামসুল আলম মিলনকে হত্যা করে। তার আত্মদানের মধ্য দিয়েই নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান চূড়ান্ত রূপ নেয়। ১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে এক জরুরি বৈঠকে বসেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, সে প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করা।
সেনানিবাসের ভেতরে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, দেশের চলমান সংকট একটি রাজনৈতিক বিষয় এবং এ সংকট সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা আরও সিদ্ধান্ত নিলেন, চলমান রাজনৈতিক সেনাবাহিনীর করণীয় কিছু নেই। এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ সেনা সদরকে প্রস্তাব দেন যে, দেশে সামরিক আইন জারি করা হবে।
আরও পড়ুন > আমাদের অসমাপ্ত প্রেম : বিদিশা এরশাদ
৩ ডিসেম্বর। তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন প্রেসিডেন্ট এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেনা কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন যেন প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগের জন্য সরাসরি বলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি পদত্যাগের কথা না বললেও তিনি জানিয়ে দেন যে, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অফিসাররা কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছেন না।
ওই সময় ঢাকা সেনানিবাসে ব্রিগেডিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে পরলোকগমন করেন তিনি। ২০১০ সালে এক গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে জেনারেল চৌধুরী বলেন, ‘উনি (সেনাপ্রধান) প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, আপনার উচিত হবে বিষয়টির দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করা। অথবা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেয়া।’
আরও পড়ুন > শেষ জীবন কেটেছে চরম নিঃসঙ্গতায়
একদিকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নানা তৎপরতা অন্যদিকে রাস্তায় এরশাদবিরোধী বিক্ষোভ। সব মিলিয়ে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।
৪ ডিসেম্বর। সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি বলেন যে, তার পদত্যাগ করা উচিত। তিনি এরশাদকে সরাসরি জানিয়ে দেন যে, ‘অবিলম্বে আপনাকে পদত্যাগ করতে হবে। আর্মি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে’- বলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী।
আরও পড়ুন > স্বৈরশাসক থেকে পল্লীবন্ধু
এ অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর রাতেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন জেনারেল এরশাদ। ওই সময় এরশাদ সরকারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন মওদুদ আহমদ। ওইদিন এরশাদ মওদুদ আহমদকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার জন্য বাংলাদেশে টেলিভিশনে পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, প্রেসিডেন্টের পরিকল্পিত নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরা।
বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচনের প্রস্তাব আগেই বর্জন করেছিল। এরপরও জেনারেল এরশাদ চেয়েছিলেন ভাইস-প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরার মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করতে। নির্দেশ মতো ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ সন্ধ্যার সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে যান এবং ভাষণ রেকর্ড করেন। ভাষণ রেকর্ডের পর মওদুদ আহমদ যখন বাসায় ফিরে আসেন তখন তিনি জানতে পারেন যে, প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কয়েক ঘণ্টার মাথায় মওদুদ আহমদকে আবারও বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণা দেবার জন্য।
আরও পড়ুন > ৯০তম জন্মদিনে যা বলেছিলেন এরশাদ
১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মওদুদ আহমদ পরে এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রথম ভাষণ রেকর্ড করে আমি যখন বাসায় ফিরে আসলাম, তখন আমার স্ত্রী বললেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোন করেছিলেন। তখন আমি ওনাকে ফোন করলাম। উনি তখন বললেন, আমি এখনই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তখন আমি ওনার বাসায় গেলাম। তখন রাতে নিউজের পরে ওনার পদত্যাগের ঘোষণা দেয়া হলো।’
এমএআর/এসআর/জেআইএম