কোথায় এরশাদ জামানার সুবিধাভোগীরা?
অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা পুরোদস্তুর আমলা ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বও পালন করেন।
কর্মঠ ও মেধাবী মানুষটিকে এক ডাকেই পাশে পেলেন এইচ এম এরশাদ। বানালেন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
আরও পড়ুন >> ডাক্তারদের মতে, এরশাদের অবস্থা অপরিবর্তিত
এরশাদের প্রস্তাব আশীর্বাদ হিসেবে নিয়ে দলে ভেড়েন জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী মওদুদ আহমদও। দল ভাঙার কারিগর বলে পরিচিতি মওদুদ আহমদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বর্তমানে। এরশাদ জামানার শেষবেলায় উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেন।
উল্লেখিত দুই ব্যক্তিই বেঁচে আছেন। রাজনীতির দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন অন্য দলে ভিড়ে, নতুবা নতুন দল গড়ে। অন্যদিকে এরশাদ এখন একাকিত্বের ঘোরে। দেশ থেকে বিদেশে, বাসা থেকে হাসপাতালের বিছানায়। লাইফ সাপোর্ট, কোমায়- সবই এখন এরশাদের সঙ্গী। অথচ সুদিনের সঙ্গীরা কেউ-ই পাশে নেই। এমনকি জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে থাকা সাবেক এ রাষ্ট্রপতিকে দেখতে পর্যন্ত আসেননি এরশাদ জামানার সুবিধাভোগীরা।
রাজনীতির দীর্ঘপথ মাড়িয়ে নানা উপাধি মিলেছে এরশাদের। স্বৈরাচার, পল্লীবন্ধু, প্রেমিক, কবিসহ নানা তকমায় পরিচিতি তার। একাধিক নারীসঙ্গ নিয়ে নানা কথাও প্রচার আছে বাজারে।
অথচ জীবন সায়াহ্নে এসে বড়ই একা এরশাদ। স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ঘরের মধ্যেও বিরাজমান ছিল। বহুকাল আগে থেকে আলাদা বসবাস তাদের।
প্রেমিক এরশাদকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্মৃতিচারণ করে লিখছেন বিদিশা সিদ্দিক। অথচ হাসপাতালে একটিবারও দেখতে আসেননি এরশাদের সাবেক এ স্ত্রী। মুখ আড়াল করে রেখেছেন অন্যরাও। এমনকি জাতীয় পার্টির মধ্যকার বর্তমান দ্বন্দ্বের জেরে রওশনপন্থীরাও এরশাদের পাশে নেই। রওশন হাসপাতালে এসেছিলেন, ঠিক যেন পরিচিত কোনো রোগীকে দেখার মতো করে।
আরও পড়ুন >> এই বুঝি আসে দুঃসংবাদ, বুক কেঁপে উঠছে বিদিশার
অথচ কতই না মধুলগ্ন কেটেছে সাবেক এ সেনা প্রশাসকের। ক্ষমতা, উপাধি, ভূষণ- সবই তাকে মহামান্বিত করেছে একসময়। রাজনৈতিক দল গঠন করেও বিশেষ আবেদন তৈরি করেছিলেন তৃণমূলে। সে আবেদন এখনও বর্তমান। বিরোধী দলে থেকেও শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভায় বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োজিত হন। অথচ সবই যেন ইতিহাস হতে চলছে। এরশাদের রাজনৈতিক সতীর্থরা আজ অন্য বনে। ভাইয়ের পাশে ভাই জি এম কাদের ছাড়া আর সবাই যেন অন্তরালে।
১৯৮১ সালের ৩১ মে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যার পর তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কর্তৃত্ব সামনে আসতে থাকে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এরশাদ এক রক্তপাতহীন ক্যু’র মাধ্যমে। ক্ষমতা নিয়েই সামরিক শাসন জারি করেন তিনি। এরপর জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া চালাতে থাকেন। হানা দেন অন্য রাজনৈতিক দলে।
১৯৮৫ সালের প্রথম দিকে এরশাদ দুটি প্রধান বিরোধী জোটে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হন। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা কোরবান আলী ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল হালিম চৌধুরীকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেন এরশাদ। ওই সময় ১৫ দলীয় জোটের শরিক দল মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একাংশ, পাঁচদলীয় জোটের শরিক ইউপিপির কাজী জাফর আহমদ ও সিরাজুল হোসেন খানের গণতন্ত্রী দল জোট ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
অন্যদিকে বিএনপির একটি অংশের নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী ও ড. এম এ মতিন এবং আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইফ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান। এছাড়া বিএনপির জিয়াউদ্দিন আহমেদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মতো আরও কিছু নেতা, মুসলিম লীগের একাংশের নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী এবং দলবিহীন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও এরশাদের আশীর্বাদ পেতে হাত মেলান।
আরও পড়ুন >> মৃত্যুর আগেই জাপার আলোচনায় এরশাদের কবর
১৯৮৫ সালের শেষ দিকে এরশাদ তার জনদল, বিএনপির একাংশ, ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় ফ্রন্ট। একপর্যায়ে কাজী জাফর স্বেচ্ছায় ইউপিপি ভেঙে এরশাদের দলে যোগ দেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘সরকারি রাজনৈতিক দল’ জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নবগঠিত পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন এইচ এম এরশাদ এবং মহাসচিব হন এম এ মতিন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরই জাতীয় পার্টির মধ্যে নানা টানাপোড়েন দেখা দেয়। তার মন্ত্রিসভার অনেকেই আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে ভিড়তে থাকেন। সময়ের ব্যবধানে জাতীয় পার্টি চারটি দলে বিভক্ত হয়। দলটির মধ্যে এখনও টানাপোড়েন বিদ্যমান।
এএসএস/এমএআর/এমএস