বাবলায় একাট্টা মহাজোট, নীরব সালাহ উদ্দিন
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৪ আসনে প্রচারণা ও সাংগাঠনিকভাবে ব্যাপক এগিয়ে রয়েছেন মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। একই সঙ্গে প্রচারণায় দারুণভাবে পিছিয়ে রয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপির প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমেদ। বৃহস্পতিবার ঢাকা-৪ আসনের নির্বাচনী এলাকা ঘুরে প্রচারণার ক্ষেত্রে এই চিত্র লক্ষ করা গেছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার এ আসনটি মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মনে করেছিলেন, একাদশ নির্বাচনে আসনটিতে ফের তাদের কোনও নেতা মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু জোটের প্রধান শরিক দল আসনটি জাপাকেই ছেড়ে দিয়েছে। তবু জাপার সঙ্গে একাট্টা আওয়ামী লীগ। জাপা নেতা সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার পক্ষেই দিনরাত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগসহ মহাজেটের শরিক সব দল।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশেনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমানে সংরক্ষিত আসনের এমপি সানজিদা খানমসহ সবপর্যায়ের নেতা-কর্মী জাপা প্রার্থীর লাঙ্গল প্রতীকের পক্ষে ভোট চাইছেন। পুরো নির্বাচনী এলাকায় লাঙ্গলের পোস্টার আর ডিজিটাল ব্যানারে সাজসাজ পরিবেশ। তবে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে পোস্টার ছিঁড়ে গেলেও ডিজিটার ব্যানারগুলো এখনও জ্বলজ্বল করছে।
বিপরীতে এ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের মূল দল বিএনপির প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমেদের প্রচারণা তেমনভাবে চোখে পড়েনি। মহাজোট নেতাদের অভিযোগ, সালাহ উদ্দিন গত বিএনপি সরকারের আমলেই জনগণের ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছেন। তারপর আর জনগণের কাছে আসেননি। প্রায় একযুগ পর ভোট চাইতে এসেছেন। জনগণ তাকে গ্রহণ করবেন না। উল্টো তাকে প্রশ্ন করছেন, এত দিন কোথায় ছিলেন?
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৭, ৫১, ৫২, ৫৩, ৫৪, ৫৮ এবং ৫৯ নং ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-৪ আসন। শ্যামপুর, জুরাইন, পোস্তগোলা, কদমতলী এলাকার এ আসনটির মোট ভোটার দুই লাখ ৪৫ হাজার ৯০৮ জন। এই আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মহাজোট প্রার্থীর প্রচারণা এবং তার পক্ষে হাঁকডাক বেশ চোখে পড়েছে। নির্বাচনী অফিসও দেখা গেছে বাজারে বাজারে, মোড়ে মোড়ে।
একই এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরেও সালাহ উদ্দিনের ধানের শীষ মার্কার কোনো ব্যানার-পোস্টার, নির্বাচনী অফিস দেখা যায়নি। প্রকাশ্যে রাস্তায় নেমে এই প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইছেন, এমন লোকজন মাঠে নামলেও তার সংখ্যা খুবই কম বলে জানা গেছে। তবে ঐক্যফ্রন্ট সমর্থিত ও বিএনপির লোকজন গোপনে গোপনে ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং ভোট চাইছেন।
বাবলা সস্ত্রীক ও মাহজোটগতভাবে দিন-রাত পরিশ্রম করে নির্বাচনী গণসংযোগ, পথসভা, সমাবেশ করছেন। অন্যদিকে হঠাৎ হঠাৎ স্বল্প সময়ের জন্য এই গলি, ওই গলিতে প্রচারণায় নামার খবর পাওয়া গেছে সালাহ উদ্দিনের। হয়রানি, গ্রেফতার এড়াতে তিনি প্রকাশ্যে পথসভা, জনসভা করছেন না। ভোটাররাও রয়েছেন নীরবে, এমনটিই জানিয়েছেন সালাহ উদ্দীন নিজেই।
জুরাইনের নতুন রাস্তা মুন্সিবাড়ী এলাকার প্রায় ৬০ বছর বয়স্ক বাসিন্দা সাইফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, এ আসনটির দুই প্রার্থীই বেশ শক্তিশালী। তবে মহাজোটের প্রার্থী বাবলার নিকট ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির প্রার্থী সালাহ উদ্দিন প্রচার-প্রচারণায় অনেকটায় কোনঠাসা হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত লাঙ্গলের পক্ষে পোস্টার-ব্যানার দেখা যাচ্ছে। মাইকে গান বাজিয়ে ভোটও চাইছে। প্রায় প্রতিদিন মিছিলও হচ্ছে। কিন্তু বিএনপির কাউকেতো দেখছি না। পোস্টারও নাই। দেখি কী হয়। তবে বিএনপির প্রর্থীও একেবারে দুর্বল নয়। শুনেছি গোপনে গোপনে তিনিও ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন এবং ভোট চাচ্ছেন।
জুরাইন, কদমতলী ও শ্যামপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি মহল্লায় নির্বাচনী কার্যালয় রয়েছে জাতীয় পার্টির। যেখানে জাতীয় পার্টি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বসে শলা-পরামর্শ করছেন।
কদমতলীর কমিশনার রোডের ভোটার স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'প্রার্থী হিসেবে আমরা অ্যাডভোকেট সানজিদা খানমকে চেয়েছিলাম। আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সানজিদা যার প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, তাকেই ভোট দেব আমরা।'
শ্যামপুর ওয়াসা রোডের একটি রিকশা গ্যারেজের মালিক ইকবাল মহাজন বলেন, এখন পর্যন্ত এলাকায় লাঙ্গলের জোয়ার বেশি। ধানের শীষের কোনও লোক নাই, পোস্টার নাই। তবে সবাই চায় সুষ্ঠু ভোট।
ঢাকা-৪ আসনের নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইলে মহাজোটের প্রার্থী ও জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ আসনে জয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী। কারণ, গত ৫ বছরে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছি। গত ৫ বছরে কারও এক ইঞ্চি জমি দখল করিনি। এ এলাকার কেউ আমাকে আতঙ্ক মনে করে না। আমি কোনও ধরনের অনিয়ম করিনি। তাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কারণে জনগণ আমাকে ভোট দেবে।’
আতঙ্কে প্রচারণা চালাতে পারছেন না এমন অভিযোগ বিএনপি প্রার্থীর বিষয়টি উল্লেখ করলে বাবলা বলেন, ‘তারতো কোনও আতঙ্ক থাকার কথা নয়। বরং তার ক্যাডার বাহিনীই দুইদিন আগে শ্যামপুর বড়িতলায় আমার নির্বাচনী প্রচারে নারীদের উদ্দেশ্যে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। আমার প্রচারণায় হামলা চালিয়েছে। আমার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে। একই সঙ্গে সালাহ উদ্দিন নিজে বলেছেন, আগামী ২৫ ডিসেম্বর যখন সেনাবাহিনী নামবে তখন আমার দলের নেতাকর্মীদের উড়িয়ে দেবেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে সালাহ উদ্দিনের শ্যামপুর বাজারের বাড়িতে গেলে বাড়ির দাঁড়োয়ান শফিক বলেন, ‘স্যার আজ একটা কাজে কোর্টে আছেন। এ জন্য আজকে স্যারের প্রচারণাও বন্ধ রয়েছে। আগামীকালকে আবার প্রচারণা শুরু হবে।’
মুঠোফোনে সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি প্রতিনিয়তই পুলিশ দ্বারা বাধা পাচ্ছি। কোনোভাবেই নির্বচনী প্রচারণা চলাতে পারছি না। আমি এখন কোর্টে আছি, এর চাইতে বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
এদিকে আজ বৃহস্পতিবারও ঢাকা-৪ আসনের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালানোসহ সভা-সমাবেশ করেছেন মহাজোটের প্রার্থী ও জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। দুপুরে শ্যামপুরের লাল মসজিদ সড়কে স্থানীয় তাঁতীলীগ আয়োজিত এক নির্বাচনী জনসভায় অংশ নেন তিনি।
এ সময় তিনি বলেন, দেশের সিংহভাগ মানুষ মহাজোটকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। কারণ, এ সরকারের আমলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। আমার ঢাকা-৪-সহ সারাদেশেই সন্ত্রাসের মাত্রা কমে গেছে। ইভটিজিং বন্ধে কড়া আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো অব্যাহত রাখার জন্য দেশবাসী পুনরায় মহাজোটকে ক্ষমতায় দেখতে চায়।
গত ১৮ ডিসেম্বর ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের মাদরাসা রোড এলাকা থেকে প্রচারণা শুরু করেন সালাহ উদ্দিন। কিন্তু এরপর তার প্রচারণা আর এভাবে দেখা যায়নি...
জনসভায় কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি তজুল ইসলাম তাজু, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজ আহমেদ, সাবেক ছাত্রনেতা মনির হোসেন স্বপনসহ আওয়ামী লীগের মহানগর ও স্থানীয় নেতারা এবং জাতীয় পার্টির নেতারা বক্তব্য দেন। পরে পোস্তগোলা বালুর মাঠে শ্রমিকলীগ আয়োজিত এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দিন বাবলা। এতে সভাপতিত্ব করেন শ্রমিকনেতা বিল্লাল হোসেন।
এদিকে ৫৩ নং ওয়ার্ড মিষ্টির দোকান এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকলীগের উদ্যোগ্যে দিনভর গণসংযোগ ও তিনটি পথসভায় বক্তব্য দেন বাবলাপত্নী সালমা হোসেন। এতে জাপার কেন্দ্রীয় নেতা শেখ মাসুক রহমান, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা কাজী সোহেলসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বক্তব্য দেন। সন্ধ্যায় ৫৩নং ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন বাবলা। এ ছাড়া কদমতলী থানা আওয়ামী লীগ ও জাপা আলাদা আলাদাভাবে লাঙ্গলের পক্ষে প্রচার মিছিল করে।
আসনটিতে ধানের শীষ ও লাঙ্গল প্রতীকধারী দুই প্রার্থী ছাড়াও হাতপাখা প্রতীকে লড়ছেন সৈয়দ মো. মোসাদ্দেক বিল্লাহ, গোলাপ ফুল প্রতীকে মো.আজাদ মাহমুদ, মিনার প্রতীকে শাহ আলম, মশাল প্রতীকে হাবিবুর রহমান শওকত, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের সহিদুল ইসলাম মোল্যা, আম প্রতীকে সুমন কুমার রায় ও কুলা প্রতীকে লড়ছেন মো.কবির হোসেন।
দশম সংসদ নির্বাচনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা নির্বাচিত হন। এর আগে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সানজিদা খানম বিএনপির আব্দুল হাইকে পরাজিত করে আসনটিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তবে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (ডেমরা থানা, খিলগাঁও থানার গজারিয়া, গৌরনগর, নাসিরাবাগ ইউনিয়ন, উত্তর দূর্গাপুর, বালদিতপুর, পূর্ব দূর্গাপুর, পশ্চিম দূর্গাপূর, নন্দীপাড়া, সবুজবাগ থানার দক্ষিণগাঁও, মানিকদিয়া, বেগুনবাড়ি ও মাণ্ডা এবং শ্যামপুর থানার কিছু অংশ) বিএনপির সালাহ উদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের হাবিবুর রহমান মোল্লাকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তার আগের নির্বাচন তথা সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাবিবুর রহমান মোল্লা বিএনপির সালাহ উদ্দিন আহমেদকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ সিপিবির সাইফুদ্দিন মানিককে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এমইউএইচ/জেড/বিএ