ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ড : দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র?

মোনায়েম সরকার | প্রকাশিত: ০৯:০৩ এএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

সচিবালয়ে ৭ নম্বর ভবনে ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এমন একটি স্থানে, যা দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল, এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনার স্বাভাবিক ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। একই সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণকর্মী সোহানুর জামানের ট্রাক চাপায় মৃত্যুর বিষয়টিও স্বাভাবিক নয়। পুরো বিষয়টি দেশবাসীর সামনে একদিকে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য প্রশ্নের।

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুরক্ষা এবং দায়িত্বশীলতার একটি গুরুতর ঘাটতি তুলে ধরেছে। সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ষষ্ঠ থেকে নবমতলা পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া এই অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ এখনো অস্পষ্ট। সরকার ইতোমধ্যেই একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তবে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়া যায়নি। তদন্তের অংশ হিসেবে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো আলামত সংগ্রহ এবং সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করছে। তা সত্ত্বেও, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং প্রশাসনিক তদারকির অভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এটা একটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত স্যাবোটাজ তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তিগত ত্রুটি, পুরোনো অবকাঠামো, অথবা অগ্নি নির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাও এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে। তাই এটি কোনো ষড়যন্ত্র নাকি নিছক দুর্ঘটনা, তা নিশ্চিত হতে প্রয়োজন সঠিক তদন্ত ।
দেশের প্রধান প্রশাসনিক ভবনে এমন অগ্নিকাণ্ড একটি সুসংবদ্ধ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সচিবালয়ের প্রতিটি ভবনেই অগ্নিনিরাপত্তা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ আধুনিকায়ন করা জরুরি ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ধোঁয়ার ডিটেক্টর, স্প্র্রিঙ্কলার সিস্টেম এবং ফায়ার ড্রিলের নিয়মিত ব্যবস্থা থাকলে এই বিপর্যয় হয়ত এড়ানো যেত।

জাতীয় নাগরিক কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের আগে বিভিন্ন মহল ষড়যন্ত্র করছে। এটি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। যদি সংস্কার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, তবে তা রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সুশাসনের জন্য হুমকি হতে পারে। সংস্কার প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রশাসনের সচ্ছলতা এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার হাতিয়ার।

রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এক নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের দেশে চালু হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই সংস্কৃতির অপপ্রয়োগ। আমরা আশা করবো, কোনো পূর্ব-অনুমানের ওপর নির্ভর না করে সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া হবে। কোনো ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের বহিঃপ্রকাশ এই তদন্তের ক্ষেত্রে না ঘটলেই দেশের মানুষ খুশি হবে।

আবার, ‘ফ্যাসিবাদী’ শক্তি কথাটি উল্লেখ করে নাগরিক কমিটি যে ইঙ্গিত করেছে না নিয়েও প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের যেখানে কোথাও দাঁড়াতেই দেওয়া হচ্ছে না সেখানে তারা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে সচিবালয়ে গিয়ে নাশকতা চালাবে- এটা অনেকের কাছেই কষ্ট-কল্পনা বলেই মনে হবে। দেশে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা অস্বাভাবিক কিছু হলে ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক শক্তির দিকে আঙুল তুলে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করা একটি অপকৌশল যা কখনো কখনো বুমেরাংও হতে পারে।

নিজেদের দায় বা ব্যর্থতা স্বীকার না করা একটি খারাপ প্রবণতা। পদোন্নতিতে কোটা সংশোধন এবং তার ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা প্রশাসনের দৃঢ়তার অভাব প্রমাণ করে। এমন বিশৃঙ্খলার পটভূমিতে সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ড, সরকারি কার্যক্রমে আরো বিভ্রান্তি এবং অনাস্থা সৃষ্টি করবে।

আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এখন একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত। দোষীদের শনাক্ত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এ মুহূর্তে সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি সচিবালয়ের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা এবং নিরাপত্তা জোরদার করাও সময়ের দাবি।

তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিশন গঠন এবং এ ধরনের ঘটনা রোধে সার্বক্ষণিক তদারকি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে। সরকার এবং প্রশাসনের সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনাকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব।

সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ড কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্ক সংকেত। এটি যদি সত্যিই ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, তাহলে তা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। আর যদি দুর্ঘটনা হয়, তবুও তা আমাদের দায়িত্ব পালনের ঘাটতির দৃষ্টান্ত।
সচিবালয় বাংলাদেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। এমন একটি স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিঃসন্দেহে দায়িত্বে অবহেলার ইঙ্গিত বহন করে। ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। কেন তারা অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারেনি?

সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভবনে নিয়মিত অগ্নিনিরাপত্তা মহড়া এবং পর্যাপ্ত সরঞ্জামের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, সেসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। ফায়ার সার্ভিসের মতে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তবে, এ ধরনের দুর্ঘটনার পেছনে নাশকতার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এই অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি ভবনের ক্ষতি নয়; এটি পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর কার্যকারিতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর একটি বড় আঘাত। সচিবালয়ের কাজ যেন কোনোভাবে ব্যাহত না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলো অস্থায়ী কার্যালয়ে স্থানান্তরিত হচ্ছে। স্থানীয় সরকার, শ্রম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য বিভাগ ইতোমধ্যেই তাদের অস্থায়ী অফিসের ব্যবস্থা করেছে। এ ধরনের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রশংসনীয় হলেও এটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। সচিবালয়ের কার্যক্রমকে পুরোপুরি সচল রাখতে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের দ্রুত মেরামত এবং পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা অগ্রাধিকার পেতে হবে।

অগ্নিকাণ্ডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ৭ নম্বর ভবনে থাকা মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোর কার্যক্রম বন্ধ না রাখার জন্য নেওয়া উদ্যোগ কার্যকর হলেও এতে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে। অস্থায়ী ব্যবস্থায় কাজ করতে গিয়ে কর্মকর্তারা নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সময় নিতে পারেন, যা কাজের গতিকে শ্লথ করে দিতে পারে। উপরন্তু, নতুন কার্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং অবকাঠামোর অভাব থাকলে প্রশাসনিক কার্যক্রমের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব সমস্যা দূর করতে সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত তহবিল বরাদ্দ এবং সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সরকারের গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি তাদের কাজ শুরু করেছে। এই কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন করেছে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। তবে, তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে দ্রুত এবং কার্যকর ফলাফল আশা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় কোনো ধরনের নাশকতা বা অবহেলা থাকলে তা চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য তদন্তের ফলাফল থেকে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ গ্রহণ করা উচিত।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এটি প্রশাসনিক নিরাপত্তা এবং দায়িত্বশীলতার ঘাটতির একটি উদাহরণ। এই ঘটনাটি সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা উচিত। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে একটি সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু সচিবালয় নয়, দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে একই ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ড আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, অবহেলার জন্য মূল্য দিতে হয়। এটি প্রশাসনের মধ্যে সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং কার্যকর নজরদারির ঘাটতি প্রকাশ করে। আমাদের এখন প্রয়োজন দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সচিবালয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, উন্নতমানের নিরাপত্তা এবং কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়া সুশাসন সম্ভব নয়। এই ঘটনাটি আমাদের শেখায় যে, সুরক্ষা এবং সতর্কতা নিশ্চিত করাই টেকসই প্রশাসনের মূল চাবিকাঠি।

রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এক নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের দেশে চালু হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই সংস্কৃতির অপপ্রয়োগ। আমরা আশা করবো, কোনো পূর্ব-অনুমানের ওপর নির্ভর না করে সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া হবে। কোনো ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের বহিঃপ্রকাশ এই তদন্তের ক্ষেত্রে না ঘটলেই দেশের মানুষ খুশি হবে। কাউকে ছাড় নয়, কাউকে অহেতুক সন্দেহ বা দোষারোপ নয়।

৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন