ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নিরাপত্তাহীনতার চাদর

প্রকাশিত: ০২:০৬ এএম, ১৫ মে ২০১৬

গত সপ্তাহে আমি পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলাম ঘুরতে। যাওয়ার পথে বিমানবন্দর থেকে গ্রুপ ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। স্ট্যাটাস দেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে এক শুভাকাঙ্খী বড় ভাই, যিনি নিজে অনেক জনপ্রিয় ও আমার খুব প্রিয় লেখক, আমার ইনবক্সে এই বার্তাটি পাঠান, ‘প্রভাষ, প্লিজ ডোন্ট ডিসক্লোজ ইউর লোকেশন অব প্রেজেন্স। পোস্ট দ্যা ফটোস অর স্ট্যাটাস আফটার ইউ আর ব্যাক। যখন যেখানে থাকবেন, তখন সেটা দেবেন না। অন্য জায়গারটা দেবেন। এইটা নিয়ে আবার স্ট্যাটাস দিয়েন না।’

বার্তাটি আমি অত সিরিয়াসলি নেইনি, তবে তার উদ্বেগ আমাকে আপ্লুত করেছে। এই বড় ভাইয়ের অনুরোধ আমার কাছে আদেশের মত, তাই বার্তাটি আংশিক পালন করেছি। কক্সবাজারে থাকার সময় আমার অবস্থান চিহ্নিত হতে পারে, এমন কোনো স্ট্যাটাস দেইনি। তবে তার শেষ অনুরোধটি রাখতে পারিনি। স্ট্যাটাস না দিলেও এই যে লিখছি। তার বার্তা পেয়ে যে আমি ভয় পেয়ে গেছি, তা নয়। তবে শুভাকাঙ্খীরা প্রায়শই এ ধরনের অনুরোধ করেন। দুদিন আগে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর একটি স্ট্যাটাস দিতয়ে প্রচুর গালি খেয়েছি এবং হুমকি পেয়েছি। সেই স্ট্যাটাসের পর আরেক প্রিয়জন ইনবক্সে পাঠালেন এই বার্তা, ‘দাদা আপনার এই মাত্রকার পোস্ট পড়ে ভীষণ মন খারাপ হলো। একসাথে টেনশন এবং ভয় হচ্ছে। কী ভয়ঙ্করও ওরা...!’

আমি স্পর্শকাতর কোনো বিষয় নিয়ে লিখলেই আমার মা ফোন করেন। আর আমার ছেলে প্রায়ই কান্নাকাটি করেন। প্রিয়জনদের উদ্বেগ আমাকে আপ্লুত করে। এত মানুষ আমার জন্য ভাবেন, এটা ভেবে ভয় নয়, একটা ভালো লাগার আবেশ ছড়ায় দেহ মনে। এতদিন ভয় খুব একটা পাইনি। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছি। স্বৈরাচার এরশাদের পুলিশের সাথে মারামারি করেছি। হলে ছাত্রশিবিরের সাথেও ঝামেলা কম হয়নি। ৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবির আন্দোলন করতে গিয়েও অনেক ঝুঁকি নিয়েছি, পুলিশের মার খেয়েছি। পেশাগত জীবনেও অনেক অনেক বিপদজনক ইভেন্ট কাভার করেছি। তাই ভয় অতটা পাই না আর। কিন্তু ইদানিং ভয়ের একটা অনুভূতি যেন আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিতে চাইছে। রাস্তায় হাঁটতে গেলে ঘাড়ের পাশটা কেমন শিরশির করে।

ইদানিং আমি প্রচুর লেখালেখি করি। দৈনিক পত্রিকায়, সাপ্তাহিক পত্রিকায়, অনলাইনে, আর কিছু না পেলে ফেসবুক তো আছেই। সব ইস্যুতেই আমি আমার অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমি লিখি আমার বিবেক যা বলে তাই। সেটা কার পক্ষে গেল, কার বিপক্ষে গেল, কে ক্ষিপ্ত হলো তা ভাবি না। আমি জানি আমার লেখা কারো কারো পছন্দ হলেও অনেকেরই হয় না। এটাই স্বাভাবিক। সবাই একমতের হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। একটা সুস্থ স্বাভাবিক সমাজে বহু মত, বহু পথ থাকবে। মতে মতে টক্কর লাগবে, যুক্তি হবে, পাল্টা যুক্তি হবে, তর্ক হবে। এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখে আসছি বহুদিন। আমি বিশ্বাস করি ভিন্নমতেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। শ্লীলতার সীমা মেনে সব ধরনের সমালোচনাকে আমি সবসময় স্বাগত জানাই। কিন্তু ইদানিং আমাদের সহিষ্ণুতা বড় কমে যাচ্ছে। আমরা তর্ক করি না, ঝগড়া করি; যুক্তি দেই না, গালি দেই। সুযোগ পেলে ঘাড়ে চাপাতি বাসিয়ে দেই। ভয়টা এখানেই।

আগে আমি আমার শত্রু চিনতাম। এখন চিনি না। অদৃশ্য  শত্রু  নিপুণ দক্ষতায় মিনিটের মধ্যে জবাই করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ব্লগার, নাস্তিক, ভিন্ন তরিকার পীর, শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক, বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান পাদ্রি, হিন্দু পুরোহিত কেউ আর নিরাপদ নয়। আগে আমরা লিখতাম ‘নিরাপত্তার চাদর’। এখন দেখি ভয়ের, নিরাপত্তাহীনতার মিহিন চাদর বিছানো চারপাশে। সবুজ বাংলা আজ রক্তে রক্তে সয়লাব। কিন্তু আমরা এই অসহিষ্ণুতার কাল  পেরিয়ে, ভয়ের চাদর উপেক্ষা করে ফিরে পেতে চাই উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে বাতাসে ভেসে বেড়াবে আজানের মুধুর সুর, ভাটিয়ালির টান, বাউলের গান, কীর্তনের সুর। বিকশিত হবে নানা মত, নানা পথ।
 
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন