ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশে কেন বারবার ‘হিন্দু কার্ড’ ব্যবহৃত হয়?

মেজর অব. আহমেদ ফেরদৌস | প্রকাশিত: ০৯:৩৪ এএম, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

উপমহাদেশের সবগুলো দেশের মধ্যে যদি সম্প্রীতির একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক জরিপ করা হতো, তবে আমি চ্যালেঞ্জ করে অগ্রিম ফলাফল বলতে পারি যে, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মার্ক পাবে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয় ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র। পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীন পরবর্তীতে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। গুগলের তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যার ১০ বছরের একটি গ্রাফ নিচে দেয়া হলো পরবর্তীতে বিশ্লেষণের জন্য :

১৯৯১ সালে ১০.৫১%, ২০০১ সালে ৯.৬০%, ২০১১ সালে ৮.৫৪% এবং ২০২২ সালে ৭.৯৫% হিন্দু জনসংখ্যা ছিল।

এই তথ্যে পরিষ্কার হয় যে, প্রতি ১০ বছরে হিন্দু জনসংখ্যা গড়ে ১% হারে কমে। এই জনসংখ্যা হ্রাসের কারণ বের করার চেষ্টা করছি।

১. দেশান্তর: আমাদের বাংলাদেশ থেকে ১-১.৫ কোটি বাংলাদেশি আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, মালয়েশিয়ায় লেখাপড়া করতে গিয়ে বা চাকরি নিয়ে বিভিন্ন কারণে উপরোক্ত দেশগুলোতে মাইগ্রেট করে। এছাড়া সরকারি চাকরি, ব্যবসায়ী ও সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ উন্নত জীবনযাপন এবং সামাজিক নিরাপত্তার কারণে বৈধ অবৈধ অর্থসহ উপরোক্ত দেশগুলো ছাড়াও দুবাই, সিঙ্গাপুরে মাইগ্রেশন করা একটি নিয়মিত ব্যাপার। উল্লেখ্য, এসব কারণে পৃথিবীর অন্য দেশেও মাইগ্রেশন হয়।

বাংলাদেশে আমরা চাই সব জাতি, গোত্র, ধর্ম ভেদাভেদের চিরস্থায়ী অবসান। আমরা বাংলাদেশি। এখানে আমরা সম্প্রীতির মিলনমেলা গড়বো নতুন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনে।

২. ভারতীয় টোপ : বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ যারা গরিব তারা কিন্তু ভারতে মাইগ্রেট করছে ভারতীয় সরকারের টোপ দেওয়ার কারণে। ভারত বাংলাদেশি হিন্দুদের জন্য যেভাবে নাগরিকত্বের টোপ ফেলে রাখে, মুসলমানদের জন্য তার বিপরীত অনুপ্রেরণা দেয়।

৩. পরিবেশ বিপর্যয়: ভারতের বাংলাদেশের প্রতি পানিবৈষম্য নীতির কারণে বাংলাদেশে বিশাল পরিবেশ বিপর্যয় হওয়ায় বাংলাদেশি হিন্দুরা ভারতে চলে যেতে আগ্রহ দেখায়।

হিন্দু কার্ড কি?

২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ এর ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার একটি প্রচ্ছদ উল্লেখ করছি।

" What's the future of Hindus in Bangladesh as Sheikh Hasina's Party Woos? "

বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে হাসিনার আওয়ামী লীগকে সেকুলার দল বলা হয়েছে। ২০২৪ এর রাজনীতির তামাশার নির্বাচনে বাংলাদেশে হিন্দুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের হিন্দুদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ সব দলই হিন্দু কার্ড ব্যবহার করেছে। ১ কোটি হিন্দু জনসংখ্যার মধ্যে ৫০-৬০ শতাংশ ভোটার ধরা হলে সব দলের জন্য বিশাল একটি ফ্যাক্টর। এই দর্শন ভারতে বিজেপি কংগ্রেস ব্যবহার করেছে, করে এবং করবে।

প্রশ্ন হলো এই কার্ড তথা সংখ্যালঘুদেরকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার কি রাষ্ট্রের জন্য উপকারী? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ও জানা বাংলাদেশের রাজনীতি তথা জনগণ বিশেষ করে সনাতন ভাই বোনদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশটা সবার। সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ভিন্ন মতাবলম্বী আস্তিক, নাস্তিক, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী ও ধর্মের মানুষের দেশ আমাদের বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে আওয়ামী লীগের ভোটের রাজনীতি ও হিন্দু কার্ড :
১/১১ পরবর্তী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি।
২০২১ সালে কুমিল্লা, চাঁদপুর চৌমুহনী এলাকায় হিন্দুদের ওপর ব্যাপক হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে দেশি বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব হামলা ভাঙচুরের ঘটনায় তৎকালীন শাসকদলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

আওয়ামী লীগ সরকার যতবার বিপদগ্রস্ত হয়েছে, ততবারই তারা হবে হিন্দু মাইনরিটির ঘাড়ে চেপে বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশে জঙ্গি কার্ড গেম খেলেছে। জঙ্গি কার্ড গেম খেলে আওয়ামী লীগ পশ্চিমে ও ভারতকে বোঝাতে চেয়েছে যে, তারা ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ জঙ্গিমুক্ত থাকবে।

নাইন/ইলেভেন পরবর্তীসময়ে পশ্চিমারা আওয়ামী লীগের জঙ্গি কার্ড গেম খেলার নাটক ধরতে পারেনি বলে আওয়ামী লীগ রাতের ভোট দিনের ভোট করে পার পেয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি সেসব দিনের কথা যখন কিছু হলেই সাধারণ মানুষকেও জামায়াত-বিএনপি-জঙ্গি তকমা দিয়ে জেল-জরিমানা বাদেও ক্রসফায়ারে মরতে দেখতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের কলিজার বন্ধু বিজেপি এ জঙ্গি কার্ড গেম খেলায় আওয়ামী লীগকে দিল খুলে সহায়তা করেছে।

বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির পরিবেশ ভারতের চেয়ে অনেক অনেক ভালো এ বিষয়ে কারও মনে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে?

বাংলাদেশের জনগণের দাবি একটি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্ত করে এটা জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা প্রচার করুক। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে বলে বিশ্বাস করতে চাই।

২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত সরকার যখন ক্ষমতায়, তখন ভোলাসহ দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। অতঃপর বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট এ বিষয়ে সরকারের কাছে নালিশ জানিয়ে আশানুরূপ ফল না পেয়ে হাইকোর্টে দ্বারস্থ হলে হাইকোর্ট তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি চুপ্পু সেই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। কমিটি ২৫ হাজার অভিযোগ থেকে ৫ হাজার অভিযোগ তথা নির্যাতনের ঘটনা আমলে নিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই প্রক্রিয়া চলতে চলতে সরকার বদল হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।

বিএনপির বিরুদ্ধে এত বড় একটা গুরুতর অভিযোগ আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ অজ্ঞাত কারণে। সবাই বলে, আওয়ামী লীগ নিজেই ভোটের প্রয়োজনে হিন্দু কার্ড গেম খেলে বিধায় বিএনপির এই ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়নি। আওয়ামী লীগ তার কিছু চিহ্নিত মার্কামারা বুদ্ধিজীবী ও হাড্ডি খাওয়া লেসপেনসর দ্বারা এই হিন্দু কার্ড ও জঙ্গি নাটক খেলে গেছে গত ১৬ বছর।

ভোলা জেলায় আওয়ামী লীগ আমলে হিন্দুদের প্রতি অন্যায় অবিচারের কথা সবার জানা থাকলেও কেন আওয়ামী লীগ এর বিচার করলো না?

এনিয়ে প্রশ্ন করেছে সবাই?

বাংলাদেশের হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিককে এ বিষয়ে যমুনা টিভির গত পূজায় টকশোতে এই প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, ভোলা জেলায় আওয়ামী লীগ হিন্দুদের ১০০ শতাংশ ভোট পায়নি বলে নাখোশ ছিলেন এবং হিংসার জেরে আওয়ামী লীগ ভোলায় মাস্টারমাইন্ড তোফায়েল আহমেদকে দিয়ে আক্রমণ চালায়।

একটা জরিপ ফলাফলের উপসংহারে পড়েছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ২০২৩ অব্দি হিন্দুদের ওপর হামলা ও সম্পত্তি দখলে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার হার ৭২ শতাংশ। হিন্দুদের ১ কোটি প্লাস জনসংখ্যার মধ্যে ৫০ শতাংশ ভোটার হিসাবে নিলে মোট সংখ্যা ৫০ লাখ, যা আওয়ামী লীগ তার পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে মনে করে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় এখন আর চোখ কান বন্ধ করে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় না বলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আওয়ামী লীগ এদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে চালিয়েছে আরাম করে।

বাংলাদেশে হিন্দুদের নিয়ে ভারতীয় প্রপাগান্ডা ও হিন্দু কার্ড ব্যবহার

৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী আমাদের দেশে মোটাদাগে তথাকথিত সুপ্রতিবেশী ভারত যেভাবে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে অনবরত প্রপাগান্ডা চালায়, তাতে অনেকের ধারণা এটা রাশিয়া ইউক্রেন অথবা ইসরায়েল প্যালেস্টাইন টাইপ দুটো দেশ। অতীব দুঃখজনক বিষয়টি কারণ বাংলাদেশ ভারতের জনগণকে আজীবন বন্ধু ভাবে এবং সেরকম সম্পর্কের নিদর্শন দেখিয়ে আসছে, যদিও বিগত পলাতক ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে অনেক অনৈতিক সুবিধা দিয়ে জনগণের সাথে বেইমানী করেছে। এসব চুক্তিগুলো ও তার শর্তাবলি তারা জনগণকে জানায়নি। জানতে চাইলে জামায়াত-বিএনপি, জঙ্গি তকমা লাগিয়ে সাইজ করেছে। শেখ হাসিনা নিজ মুখে বলেছেন ভারতকে আমি, যা দিয়েছি, তারা তা কল্পনাও করতে পারবে না।

ভারতের বিজেপি সরকার ও সাউথ ব্লক বাংলাদেশের সাথে কখনোই বন্ধুসুলভ আচরণ করেনি। ভারতের এই দাদাগিরি স্বভাবের জন্য ভারত আজ এক বন্ধুহীন রাষ্ট্র। ইসারায়েল তার মিত্র বিধায় বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোর বিরুদ্ধে ভারত আওয়ামী সরকারের প্রভাব খাটিয়ে বহু ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটায়। শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের নিরীহ কচি বাচ্চাগুলোর লাশ ও বিভৎস ঘটনাগুলো স্মরণ করে দেখুন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নেওয়ার আগে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে বলেছিল, ভারত যদি বাংলাদেশের বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে তাহলে ভারত, মিয়ানমার ও ভারতের সেভেন সিস্টার এক নাও থাকতে পারে। এরপর থেকে গত তিন মাসে ভারতীয় মিডিয়া ইউনূস স্যারের পেছনে আদা জ্বল খেয়ে নেমেছে।

বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো দুঃখজনকভাবে কাউন্টার প্রপাগান্ডা তো দূর কি বাত, আমাদের দেশে মাইনরিটি নির্যাতন যে হয় না, তা বিশ্ববাসীর কাছে খোলাসা করতে পেরেছে কি? এর মাঝে ইলিশ ডিপ্লোম্যাসি ও জাতিসংঘে মোদির সাথে ইউনূস স্যার দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও মোদি এড়িয়ে যান। কারণ হয়তো শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কিত প্রশ্ন করে বসলে মোদি বিব্রত হবে।

ভারতীয় সরকার যে বাংলাদেশের জনগণের সাথে সম্পর্কের চেয়ে তাদের পোষ্যকে অগ্রাধিকার দেন - তা আজ পরিষ্কার জনগণের কাছে।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের ভেতরে এত সুন্দর সম্প্রীতি থাকা সত্ত্বেও হিন্দু জনসংখ্যা কমতির কারণ কি?

উত্তর :

১. বাংলাদেশী হিন্দুদেরকে ভারতীয় সরকার কর্তৃক নাগরিকত্ব টোপ।

২. অর্থনৈতিক

৩. পরিবেশ

উপসংহার:

বাংলাদেশের মাইনরিটি হিন্দু ভাই বোনদের নিয়ে খেলা বাংলাদেশের মেজরিটি মুসলমানরা বরদাশত করবে না। তারা ইসকনকে দিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজন নিয়ে বিরক্ত ও চিন্তিত। ইসকন একটি সংগঠন যার সমর্থনকারী উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শধারী।

বাংলাদেশে আমরা চাই সব জাতি, গোত্র, ধর্ম ভেদাভেদের চিরস্থায়ী অবসান। আমরা বাংলাদেশি। এখানে আমরা সম্প্রীতির মিলনমেলা গড়বো নতুন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনে।

লেখক: রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

এইচআর/জিকেএস