তাঁদের কথা বলছে বাংলাদেশ
নির্ঘুম রাতে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। এই অপেক্ষা ৪৫ বছরের। অবশেষে এলো সেই ক্ষণ। মঙ্গলবার রাত ১২টা ১০ মিনিট। ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হলো মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াতের আমির বদর বাহিনীর প্রধান ঘাতক মতিউর রহমান নিজামীকে। আর এর সাথে শেষ হলো দেশবিরোধী এক নৃশংস ঘাতকের দিন। স্বস্তি ফিরে এলো শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বজনসহ দেশবাসীর।
এক সময় কল্পনাও করা যেত না যে এই নরঘাতকদের আইনের আওতায় আনা যাবে। কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সৌদি আরবে পালিয়ে গেলেও পচাঁত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের সহযোগিতায় একাত্তরের ঘাতকরা দেশে ফিরে। এক সময় তাদের গাড়িতে ওঠে জাতীয় পতাকা। তখন আফসোস করে বলা হতো ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ? শহীদের উত্তর প্রজন্ম কথা রেখেছে। পিতৃপুরুষের রক্তের ঋণ শোধ করছে তারা। সত্যের জয় অমোঘ। সময়ের পরিক্রমায় নিজামীর দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ বিচারে আরো একটি মাইলফলক স্থাপিত হলো। কলঙ্কমোচনের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গেলো একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছর পর যুদ্ধাপরাধের বিচার ছিলো একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। কেননা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে দেশ আবার পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ স্রোতে। এসময় জেলে আটক যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী সংগঠন নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন সামরিক শাসক জিয়া। শুধু তাই নয় যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদর, আল-শামসরা রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করেন জিয়া। এরই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়া নিজামী, মুজাহিদের গাড়িতে তুলে দেন শহীদের রক্তখচিত লাল-সবুজ পতাকা। কিন্তু সবদিন সমান যায় না। অবেশেষে ঘাতকের দিন শেষ হতে থাকে। জনরায় নিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি যুদ্ধাপরাধ বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল গঠন করেন। এরপর একে একে গ্রেফতার করা হয় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের। ইতিমধ্যেই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, এম কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। সবশেষ নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হলো । এর মধ্যদিয়ে জাতি একে একে কলঙ্কমোচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ ফিরে আসছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারায়।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে জাতি। অপরাধ করলে যে কেউ পার পায় না এই বার্তাটিও পৌঁছে যাচ্ছে সমাজে। এর মধ্য দিয়ে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে। গণতন্ত্র আরো মজবুত ভিত্তি পাবে। শোষণ, বঞ্চনাহীন অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেই দিকে।
এইচআর/এমএস