ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রোহিঙ্গা সংকট : জটিল হচ্ছে সমাধানের পথ

ইয়াহিয়া নয়ন | প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছেনা। সমাধান বাংলাদেশের ভেতরে নয়, সমাধান আন্তর্জাতিক মহলের হাতে। বাংলাদেশ নানা ভাবে চেষ্টা করে চলেছে। আন্তর্জাতিক মহলে বিভিন্ন ফোরামে, জাতিসংঘে সংকটের কথা তুলে ধরেছে। দেখতে দেখতে সাত বছর পার হয়ে গেছে। এসেছিল বারো লাখ, সাত বছরে জন্ম নিয়েছে আরো অন্তত তিন লাখ। আইন শৃঙ্খলা আর পরিবেশের বারোটা বেজেছে অনেক আগেই। মানবপাচার আর মাদকপাচারের হটস্পট এখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো।

রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবসনই একমাত্র সমাধান হলেও নানা জটিলতায় আটকে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জরুরি। মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ বন্ধে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রভাবশালী দেশগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে অবস্থিত আরাকানের উত্তরে মিয়ানমারের চিন স্টেট, ম্যাগওয়ে রিজিয়ন, বাগো রিজিয়ন, পূর্বে ইরাবতি অঞ্চল, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থিত। মিয়ানমারের আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক শাখা আরাকানকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য লড়াই করছে।

রাখাইনরা থেরোবাদী বৌদ্ধ মগ। মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের বৌদ্ধদের থেকে তারা আলাদা। মিয়ানমার ১৭৮৪ সাল থেকে জোরপূর্বক আরাকানকে দখল করে রেখেছে এবং তারা ঔপনিবেশিক শক্তি। মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকানের রাখাইনরা লড়াই করলেও দু’পক্ষের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। তা হলো- দুই পক্ষের কেউই রোহিঙ্গাদের আরাকানের মূল জাতিসত্তার অংশ মনে করে না।

আরাকানি বৌদ্ধ রাখাইন মগদের হাতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। ২০১২ সালের দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল তারাই। রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার না পেতে পারে, সে জন্য তারা জোরালো আন্দোলন করে আসছে দশকের পর দশক। তাদের দাবি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের পরিচয়কে ঘিরে আরাকানের রাজনীতি ও সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আবর্তিত হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়; আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানি মুসলমানের বংশধর।

আরাকান আর্মি আরাকানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হলেও এদের ক্যাডারদের অবস্থান মুখ্যত কাচিন এলাকায়। সেখানে লাইজা অঞ্চলে তাদের সদর দপ্তর। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামনে শক্ত চ্যালেঞ্জ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে গোষ্ঠীটি। রাখাইনের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলেই শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে তাদের।

এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে নিজেদের অভয়রাজ্য গড়ে তুলেছে। অনেক এলাকায় গড়ে তুলেছে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। তবে প্রধান সংঘর্ষস্থল হলো চিন স্টেটের পালিতওয়া। বান্দরবান সন্নিহিত কালাদন নদীর পাড়ের এই স্থান বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত।

২০০৯ সালে তরুণ ছাত্রনেতা তোয়ান ম্রেট নায়েংয়ের নেতৃত্বে মাত্র ২৯ জন নিয়ে গড়ে ওঠা আরাকান আর্মি দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। রাখাইন জনগোষ্ঠীর মাঝে রয়েছে তাদের বেশ জনপ্রিয়তা। বর্তমানে তাদের ২০ হাজার সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক উইং ‘ইউনাইটেড লীগ ফর আরাকান’ (ইউএলএ)।

আরাকান আর্মি হলো মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের অপর গেরিলা গ্রুপ ‘আরাকান লিবারেশন আর্মি’ বা ‘এএলএ’র থেকে পৃথক একটি সংগঠন। এএলএ হলো আরাকানের সবচেয়ে প্রাচীন গেরিলা দল। বর্তমানে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে তাদের যুদ্ধবিরতি চলছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনাভিযানে এএলএর ভূমিকা ছিল সহায়কের।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীন-ভারতের অতি ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও কোনো দেশই রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। অধিকন্তু, বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুই দেশ হয় সরাসরি বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, নয়তো ভোটদানে বিরত থেকেছে। তাই সংকট সমাধানের জন্য আমাদেরই জোর তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির তৎপরতার দিকে নজর দিতে বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। গত জুনে, মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্তে রাখাইন রাজ্যের জাতিগত আরাকান আর্মি (এএ) এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আরাকান আর্মি একটি রাখাইন বৌদ্ধ সশস্ত্র সংগঠন, যা প্রায় ২০ হাজার যোদ্ধা নিয়ে গঠিত। আরাকান আর্মি চীনা অস্ত্র পাচ্ছে, একটি বার্মিজ বিদ্রোহী গোষ্ঠী যা একটি চীনা প্রক্সিও।

আরাকান আর্মি থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের একটি অংশ, যার চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে; এই বছরের জানুয়ারিতে, চীন বিদ্রোহীদের এবং সামরিক জান্তার মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করে। চীন-সমর্থিত আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের একটি বিশাল এলাকা দখল করেছে যা বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী উভয় দেশের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা উদ্বেগ।

রাখাইন রাজ্যটি ভারতের কালাদান প্রকল্পের আবাসস্থল, একটি ৪৮৪ মিলিয়ন ডলারের মাল্টি-মডেল সংযোগ প্রকল্প যার লক্ষ্য ভারতের ল্যান্ডলকড উত্তর-পূর্বকে সিত্তওয়ে বন্দরের সাথে সংযুক্ত করা। তবে জানুয়ারিতে আরাকান আর্মির মিয়ানমারের পালেতোয়া শহর দখল করার পর এই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবে বাংলাদেশের জন্য রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।

আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার জন্য অভিযুক্ত, যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আরেকটি দেশত্যাগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইতোমধ্যেই ছোট ছোট দলে কয়েক দফা রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই প্রবেশে ঢল নামার শঙ্কা রয়েছে।

একটি ইতিবাচক সংবাদ হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতির শিকার ১৬ বাংলাদেশি জেলেকে ফেরত দিয়েছে মিয়ানমারের আরাকার আর্মি। বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ।

২৮ সেপ্টেম্বর সকালে কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়া ফিশারি ঘাট হতে ১৬ জন জেলে একটি ট্রলারে গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যান। ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় তিনটি ট্রলারে করে ডাকাতদল আক্রমণ করে। জেলেদের মারধর করে ট্রলারটির ডেকের ভিতরে বন্দি করে রাখে। পরে গত ৭ অক্টোবর ভোরে ডাকাতরা জেলেদেরকে বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার অংশের একটি চরে ছেড়ে দেয়।

পরবর্তীতে জেলেরা দেশটির স্থানীয় বাসিন্দাদের মাধ্যমে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জেলেরা প্রায় ছয় দিন আরাকান আর্মির হেফাজতে থাকার পর রোববার বিজিবিকে অবহিত করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের একটি প্রতিনিধিদল আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে টেকনাফের নাফ নদীর শাহ পরীর দ্বীপ জেটিঘাট দিয়ে ১৬ জেলে বাংলাদেশে ফেরত এসেছে। এটা এই কারণেই ইতিবাচক যে, আরাকান আর্মি আমাদের বর্ডার গার্ডের ডাকে ইদিবাচক সাড়া দিয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীন-ভারতের অতি ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও কোনো দেশই রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। অধিকন্তু, বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুই দেশ হয় সরাসরি বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, নয়তো ভোটদানে বিরত থেকেছে। তাই সংকট সমাধানের জন্য আমাদেরই জোর তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন