আহসান উল্লাহ মাস্টার : মুখোশের ভিড়ে মানুষের মুখ
আহসান উল্লাহ মাস্টার। তাকে ভীষণ মনে পড়ে আমার। মন পোড়ে। যিনি একই সঙ্গে শিক্ষক ছিলেন। শ্রমিকনেতা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি আমার কাছে, সবচেয়ে শ্রদ্ধার মানুষদের একজন। তার সবচেয়ে বড় পরিচয়- তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন। মানুষপ্রেমী ছিলেন। মানবতাবাদী ছিলেন। মানুষকে ভালোবাসতেন।
আমরা অনেক কিছুকেই শক্তি বলে মনে করি। ক্ষমতাকে। অর্থকে। অস্ত্রকে। কিন্তু সেসব আসলে শক্তি নয় বরং দুর্বলতা। অর্থ থাকে না। ক্ষমতা থাকে না। অস্ত্রও না। থাকে মানুষ, মানুষের ভালোবাসা। মানুষের চেয়ে, মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো শক্তি জগতে নেই। জগৎ আসলে মানুষই, সেটা যিনি বুঝতে পারেন, তিনি পারেন মানুষের হৃদয় জয় করতে। আহসান উল্লাহ মাস্টার সেটি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মানুষও তাকে। মানুষের নেতা হতে পেরেছিলেন।
সমাজে দুই শ্রেণির মানুষ থাকে। যোদ্ধা ও ভিক্ষুক। ভিক্ষুকেরা অন্যের অনুগ্রহে বাঁচে। আপোসকামী, সুবিধাবাদী তারা। অবস্থার পরিবর্তন চায় না। প্রচলিত ব্যবস্থার সুবিধা তারা নিতে চায়, নেয়ও। যোদ্ধারা পরিবর্তন চায়। তারা শ্রম দেয়। তারাই বদলায় সমাজকে। এগিয়ে নেয় জাতিকে। দেশকে। আহসান উল্লাহ মাস্টার যোদ্ধা ছিলেন। সমাজকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।
শ্রমিকনেতা সবাই হতে পারে না। সবাই শ্রমিকও হতে পারে না। পারে একমাত্র সাহসী সংগ্রামী মানুষেরা। যারা মানুষের উন্নয়ন চায়, কল্যাণ চায় সমাজের। তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখেননি কখনো। দেখেছেন সমষ্টিগত স্বার্থ। সমষ্টিগত কল্যাণ ও উন্নয়ন। যার কারণে মুক্তিযুদ্ধ শেষে ফিরেও নিজেকে ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হিসেবে পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে। ফলে কেবল দেশ নয়, দেশের বাইরেও ছিল তার পরিচিতি।
২০০৪ সাল। ৭ মে। বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায়। নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চবিদ্যালয়। জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন তিনি। প্রকাশ্য জনসভায়, একদল সন্ত্রাসী যারা বিএনপির মদদপুষ্ট। গুলি করে, হত্যা করে তাকে। নিহত হয় আরও অনেকে। রতন, হানিফ, মনির, আফাজ। পাথরভাঙা আর্তনাদ। রক্ত-অশ্রু। সে এক ভয়াবহ চিত্রকল্প। মানুষ মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে না। কেউ কোনো দিন এমনভাবে দেখেনি মানুষকে হত্যা করতে। সেদিন রাসেল গিয়েছিল পরীক্ষা দিতে, ব্রিটিশ কাউন্সিলে। ফিরে এসে দেখে আততায়ীরা হত্যা করেছে বাবাকে।
আহসান উল্লাহ মাস্টারকে যারা হত্যা করেছিল তারা কারা? তারা সেই সব লোক, যারা মনে করে, হত্যা করেই মানুষের আদর্শ মুছে দেওয়া যায়। যারা প্রগতিবিরুদ্ধ। যারা শ্রমিকদের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিতে চায়। যারা উন্নয়নের বাধা, তারাই তাকে হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর চেতনা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সেই মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে তারাই যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। যারা বাংলাদেশ চায় না। এখনো যাদের পাসপোর্টে বাংলাদেশ, কলিজার ভেতর পাকিস্তান। তারাই আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করেছে। যারা ভেবেছে হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাস বদলে দেওয়া যায়। হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা যায়।
কিন্তু না, তা নয়। ইতিহাস তা বলে না। যারা মানুষকে হত্যা করে তাদের চেয়ে নীচ, বর্বর, মূর্খ এই জগতে নেই। আহসান উল্লাহ মাস্টারকে তারা হত্যা করেছে ঠিকই কিন্তু তার আদর্শ, বিশ্বাস, দর্শন, চেতনাকে কীভাবে হত্যা করবে? আদর্শের কখনো মৃত্যু হয় না, চেতনার মৃত্যু হয় না কখনো। চেতনায় আজ আমরা একেকজন আহসান উল্লাহ মাস্টার।
আজকে বাংলাদেশে অনেক কিছু পরিষ্কার। তথাকথিত নিরপেক্ষতার ভান করার সুযোগ আর নেই। এখন দর্শন একটাই। পক্ষ একটাই। বাংলাদেশ পক্ষ। এখন লড়াই বাংলাদেশ দর্শন বনাম পাকিস্তান দর্শনে। বাংলাদেশের সকল মানুষ বাংলাদেশকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, তা না হলে আজকের বাংলাদেশ হতো না। শুধু কিছু মানুষ যারা তখনো চায়নি, এখনো চায় না বাংলাদেশ থাকুক। যাদের মুখে জয় বাংলা বলতে জড়তা, সংকোচ, দ্বিধা। তারাই আহসান উল্লাহ মাস্টারের হত্যাকারী। তারাই হত্যাকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের।
এই হত্যাকারীরা আজ চিহ্নিত, বাংলাদেশবিরোধীরাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরাই। আসুন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাই, স্বপ্ন পূরণ হবে আহসান উল্লাহ মাস্টারের। আহসান উল্লাহ মাস্টারের স্বপ্ন ছিল একটাই- এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ।
মনে পড়ে। ভীষণ মনে পড়ে, মানুষটিকে আমার। মানুষটি মানুষ ছিলেন। মানুষটি মানুষের ছিলেন। চারপাশে শুধু মুখোশের ভিড়। মুখোশের ভিড়ে মানুষ খুঁজি আমি, পাই না। আমার ভালোবাসার মানুষ। ভীষণ ভালোবেসেছিলাম তাকে। আজও বাসি। বিশ্বাসে ও আদর্শে। চেতনায় ও দর্শনে। ভালোবাসায় ও মানবতাবাদে।
লেখক: উপ-সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ।
এইচআর/এমএস