ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

এক হাজার টাকার শপিংয়ে ৫০ টাকার ব্যাগ

আমীন আল রশীদ | প্রকাশিত: ০৯:১৪ এএম, ০৭ অক্টোবর ২০২৪

গ্রিন রোডে অবস্থিত একটি সুপারশপ থেকে কিছু জিনিসপত্র কেনার পরে বিল দেয়ার সময় কাউন্টারের কর্মীর সঙ্গে কথোপকথন।

- স্যার ব্যাগ নিয়ে এসেছেন?
- না।
- তাহলে ব্যাগ কিনতে হবে।
- ওকে। কত দাম?
- ২৫ টাকা।
- কিন্তু এই জিনিস তো এত ছোট ব্যাগে ধরবে না।
- তাহলে স্যার দুটি ব্যাগ লাগবে।
- মানে ৫০ টাকা?
- জ্বি স্যার।
- এগুলো কীসের ব্যাগ?
- কাপড়ের।

একটি ব্যাগে নুডুলস আর আটা ঢুকানোর পরে দেখা গেলো যে বাকি জিনিস আর ধরে না। অতএব আরেকটা ব্যাগ। এক হাজার টাকার কেনাকাটায় ৫০ টাকার ব্যাগ!

গত পয়লা অক্টোবর থেকে সুপার শপে পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। পরিবেশের স্বার্থে নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। আগামী মাস থেকে কাঁচাবাজারেও এর প্রয়োগ শুরু হওয়ার কথা। সেটি আরও ভালো খবর। কিন্তু বাজার করতে গিয়ে কাস্টমারকে যে কাপড়ের ব্যাগ কেনার জন্য অনেক বেশি টাকা দিতে হলো, তার সমাধান কী? একজন নাগরিক কেন এই বাড়তি খরচ করবেন?

পয়লা অক্টোবর সুপার শপে পলিথিনের শপিং ব্যাগের বিকল্প ব্যবহার কর্মসূচির উদ্বোধন করে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। তবে এই অভিযান শুধুমাত্র পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে। অতএব এখন থেকে কেউ সুপার শপে বাজার করতে গেলে পলিথিন শপিং ব্যাগ আনতে পারবে না বা বাজার থেকেও নিতে পারবে না। পরবর্তীতে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকও বন্ধ করা হবে। এ জন্য জনগণ, ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশের পরিবেশে পলিথিন একটি বিরাট ঘাতকের নাম। ২০২০ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর খননকাজ ব্যাহত হয় শুধুমাত্র নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর থাকায়। খনন করতে গিয়ে যখন দেখা যাচ্ছিলো যে বারবার ড্রেজারের পাখা ভেঙে যাচ্ছে, তখন অনুসন্ধান করে যায়, কর্ণফুলীর অনেক স্থানে পলিথিন ও প্লাস্টিকের দুই থেকে সাত মিটার আকারের স্তর জমেছে। ওই পলিথিন ও প্লাস্টিকের ড্রেজারের পাকা ভেঙে যাচ্ছে। ফলে চীন থেকে আনা সাকশন ড্রেজারটি ফেরত পাঠানো হয়।

বাস্তবতা হলো, পলিথিন মাটির সাথে মেশে না এবং শত শত বছর ধরে ক্ষয় হয় না। এটি মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা কমিয়ে দেয় এবং ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। পলিথিন মাটির বায়ুচলাচল এবং পানি শোষণের ক্ষমতা নষ্ট করে। ফলে মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।

পলিথিন নালা, খাল ও নদীতে জমে জলাধারের প্রবাহ ব্যাহত করে। এটি বন্যার ঝুঁকি বাড়ায় এবং জলের স্বাভাবিক প্রবাহের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া পলিথিন পানির গুণগত মান খারাপ করে এবং জলজ প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর।

পলিথিন বন্যপ্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। পশু-পাখিরা পলিথিনকে খাবার হিসেবে ভুল করে এবং তা খেয়ে ফেলে, যা তাদের জীবননাশের কারণ হয়। পলিথিনের ফাঁদে আটকে পড়ে প্রাণীরা আহত ও নিহত হতে পারে।

পলিথিন বর্জ্য আবর্জনার সাথে মিশে যায় এবং যেসব এলাকায় এটি পুড়িয়ে ফেলা হয়, সেখানে বায়ু দূষণের ঝুঁকি থাকে। পলিথিন পুড়িয়ে দিলে কার্বন মনোক্সাইড, ডাইঅক্সিন এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয়, যা মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যাসহ বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ৬৪ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। এখানে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে।

অতএব পলিথিনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান বা জিরো টলারেন্সের বিকল্প নেই। কিন্তু পৃথিবীকে পুরোপুরি পলিথিনমুক্ত করা হয়তো সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে তো নয়ই। তবে যতটুকু পুরুত্বের পলিথিন পরিবেশের জন্য তুলনামূলক কম ক্ষতিকর, সেরকম পলিথিন বা শপিং ব্যাগের ব্যবহারের অনুমতি থাকতে হবে। কিন্তু পাশাপাশি পলিথিনের শপিং ব্যাগের কার্যকর ও সহজলভ্য বিকল্পও রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে সুপার শপে জিনিসপত্রের সাধারণ বাজারের চেয়ে এমনিতেই বেশি। তারপরও সেখানে যদি ব্যাগের জন্য এখন একজন ক্রেতাকে ৫০ টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়, সেটি অনেকেরই গায়ে লাগবে।

পলিথিন নিজেই একটি বিকল্প হিসেবে আমাদের যাপিত জীবনে অনুপ্রবেশ করেছে। সহজলভ্যতা ও স্থায়ীত্বের কারণে সে দ্রুতই চট ও কাপড়সহ অন্যান্য উপাদানের ব্যাগ হটিয়ে দিয়ে বাজারে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেছে। অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারী হয়েও সে নিজেই এখন সবচেয়ে ক্ষমতাবান! ফলে এটিই একটি বড় ট্র্যাজেডি যে, যে পলিথিন এসেছিল চট ও কপড়ের ব্যাগের বিকল্প হিসেবে, সেই পলিথিনেরই এখন বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে!

সুপার শপগুলোয় আগে জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রয়োজনে একাধিক ব্যাগ দিতো। সেগুলোও প্লাস্টিকের। পলিথিনের শপিং ব্যাগ নয়। অর্থাৎ সরকার যে পলিথিন নিষিদ্ধের কথা বলেছে, সুপার শপে পণ্যের সাথে দেয়া ব্যাগগুলো সেরকম ছিল না। অথচ পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধের উসিলায় তারা ওই ব্যাগটিও দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ সেই ব্যাগটির একটা ক্রয়মূল্য আছে। খুচরা দোকানে ওই ব্যাগ ১০ টাকা বিক্রি করে। তার মানে এখন সুপার শপওয়ালাদের জন্য দুইভাবে ব্যবসার পথ খুলে দেয়া হলো:

১. আগে যে ১০ টাকা দামের ব্যাগ তারা জিনিসপত্রের সঙ্গে দিতো, সেটি দিতে হচ্ছে না।

২. এখন তারা প্রতিটি ব্যাগের বিনিময়ে কাস্টমারের কাছ থেকে যে ২৫ টাকা নিচ্ছে, সেখানেও ব্যবসা করছে। কারণ এই ব্যাগ তারা ১০-১৫ টাকার বেশি দিয়ে কেনেনি। তার মানে এখানে প্রতিটা ব্যাগে তারা ব্যবসা করছে ১০ টাকা এবং আগে যে ব্যাগ দিতো সেটি না দেয়ার ফলে তাদের বেঁচে যাচ্ছে আরও ১০ টাকা। মোট ২০ টাকা। তাহলে প্রতি মাসে তাদের বাড়তি কত টাকা প্রফিটের ব্যবস্থা করে দেয়া হলো আর কাস্টমারের পকেট থেকে বাড়তি কত টাকা কাটা হলো?

পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেটা ব্যবহার করে কেউ মানুষকে ঠকালো কি না এবং কিছু দুষ্টু লোক আরও বেশি মুনাফার সুযোগ পেলো কি না—সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। যেকোনো জিনিসের উত্তম বিকল্প সহজলভ্য করাটা খুব জরুরি।

বস্তুত এবারই যে প্রথম পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা নয়। দেশে প্রথম এই ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। ২০১০ সালে দ্বিতীয় বারের মতো পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। কিন্তু সেই নিষিদ্ধের ফলাফল যে শূন্য, সেটি চারপাশে তাকালেই স্পষ্ট হবে। কেন পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না তার সহজ উত্তর হলো পলিথিনের সহজ বিকল্প বাজারে সহজলভ্য করা যায়নি।

দশ টাকায় পলিথিনের শপিং ব্যাগ পাওয়া যায় অন্তত দশটি। যার একেকটি ব্যাগে অনায়াসে ৭-৮ কেজি মাছ মাংস সবজি ও ফল বহন করা যায়। অথচ পলিথিনের শপিং ব্যাগের বিকল্প হিসেবে এখন সুপার শপে যে কাপড়ের ব্যাগ দেয়া হচ্ছে, তার একেকটির দাম ২৫ টাকা! পাটের ব্যাগও হয়তো অনেক বেশি পরিমাণে বাজারে আসবে। কিন্তু তার সাইজ কী হবে, দাম কেমন হবে, সব জায়গায় পাওয়া যাবে কি না—তা নিয়ে অনেক সংশয় আছে। বাজার থেকে কাঁচা মাছ ও মাংস আনার জন্য পলিথিনের শপিং ব্যাগের উত্তম বিকল্প কী হবে? কাপড়ের ব্যাগে মাছ মাংস বহন করলে তার রক্ত ও পানি রাস্তায় পড়বে। সুতরাং এরও একিট কার্যকর বিকল্প থাকতে হবে।

পলিথিনের প্রথম বিকল্প সোনালি ব্যাগ যা পাট থেকে তৈরি এক ধরনের পলিথিন ব্যাগ। এটি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান। পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ সহজেই মাটির সাথে মিশে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই ব্যাগটিকে জনপ্রিয় করা যায়নি।

এর বাইরে সিনথেটিক ফেব্রিক দিয়ে বানানো ক্যানভাস ব্যাগ ও কাগজের ব্যাগও অন্যতম বিকল্প। কিন্তু এগুলোরও ধারণক্ষমতা, সাইজ, দাম ও সর্বত্র প্রাপ্যতা নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এসর ব্যাগ এমনভাবে বানানো উচিত যাতে এগুলো বাজার থেকে এনেই ডাস্টবেন ফেলে দিতে না হয়। যাতে এগুলো একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। কয়েকবার ব্যবহার করা গেলে দাম নিয়ে ক্রেতাদের অসন্তুষ্টি কমবে। কিন্তু প্রতিবার বাজারে গিয়ে যদি শুধু ব্যাগের পেছনেই তাকে ৫০ টাকা খরচ করতে হয়, সেটি অনেকের জন্যই কষ্টকর হতে পারে।

তবে সুপার শপগুলো আগে যেমন পণ্যের সাথে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ব্যাগ দিতো তারা যেন আগের মতোই পণ্যের সাথে বিনা মূল্যে ব্যাগ দেয় এবং এর জন্য বাড়তি চার্জ না কাটে, সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি।

সেই সাথে যেসব মালিকের পলিথিন উৎপাদনের কারখানা রয়েছে তাদের পাটের ব্যাগ তৈরির মেশিন কেনার জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও অন্যান্য প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। পলিথিনের উত্তম বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগের মধ্য দিয়ে সোনালি আঁশের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যায়।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, পলিথিন নিজেই একটি বিকল্প হিসেবে আমাদের যাপিত জীবনে অনুপ্রবেশ করেছে। সহজলভ্যতা ও স্থায়ীত্বের কারণে সে দ্রুতই চট ও কাপড়সহ অন্যান্য উপাদানের ব্যাগ হটিয়ে দিয়ে বাজারে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেছে। অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারী হয়েও সে নিজেই এখন সবচেয়ে ক্ষমতাবান! ফলে এটিই একটি বড় ট্র্যাজেডি যে, যে পলিথিন এসেছিল চট ও কপড়ের ব্যাগের বিকল্প হিসেবে, সেই পলিথিনেরই এখন বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে!

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন