ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ব্যবসার পরিবেশে দুর্নীতির কেউটে সাপ রুখে দাঁড়ান

ইব্রাহিম পাঠান | প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দেশের সিটি করপোরেশনগুলোতে রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষরে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হলেও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে এই কাজ নিজেই দখলে রেখেছিলেন সাবেক মেয়র জায়েদা খাতুন। যদিও কে কত টাকায় ট্রেড লাইসেন্স পাবেন সেই সিদ্ধান্ত দিতেন তার উপদেষ্টা, সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গির হোসেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সিটি করপোরেশনটিতে কোনো নির্বাচিত মেয়র না থাকায় ব্যবসা সেবার এই গুরুত্বপুর্ণ কাজটি আটকে গেছে। ফলে ঝুলে আছে বহু ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন। বহু সরকারি অফিসে ব্যবাসা সেবার ফাইল আটকে রাখার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা আদতে ঘুস নিতে না পারায় ফাইলও ছাড় করছেন না বলেই অভিযোগ প্রায়শই পাওয়া যাচ্ছে।

জনগণের টাকায় বেতন নিলেও শেখ হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছর ৭ মাসের টানা শাসনকালে শিল্প ও বাণিজ্যখাতের নিয়ন্ত্রক এবং সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শত শত স্বৈরাচারী মনোাভাবের কর্মচারী তৈরি হয়েছেন। আইন মেনে সেবা দেওয়া তাদের প্রধান কর্তব্য হলেও এদের বেশিরভাগের আচরণ কিছুটা উদ্ধত-কাউকে পরোয়া করি না ধরনের। মোটাদাগে দৃশ্যকল্পটা এমন… চারপাশে ফাইলের স্তূপ ও একটা কম্পিউটার নিয়ে আরামে বসে আছেন লোকটা। খুব ব্যস্ত হয়ে কখনো মুঠোফোনে স্ক্রল করছেন। আগের পরিচয় না থাকলে তার কাছে পৌঁছানো সহজ নয়।

যদিওবা পৌঁছানো যায় তাহলে সেবা প্রত্যাশী নিজেকে ভাগ্যবান বা ক্ষমতাবান মনে করেন নিশ্চিত। জনাবের কাছে কিছু জানতে চাইলে উত্তর দেবেন অর্ধেক, তবে মাথা তুলেও তাকাবেন না। ‘স্যার’ বলে মিনতি করলে হয়তো তার মন গলতে পারে। সাথে থাকতে হবে টাকার খাম পাওয়ার প্রতিশ্রুতি অথবা নগদনারায়ণ। এরপরই শুধু ধুলাঝাড়া ফাইল তুলে দেখবেন তিনি। টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করবে নথিতে ভুল আছে কি নেই। সন্তুষ্ট হলেই কেবল স্বাক্ষর করে ঊর্ধ্বতনের কাছে পাঠাবেন তিনি। ইচ্ছা না চাইলে সোজা বলে দেবেন- ‘হবে না। কাগজ ঠিক করে নিয়ে আসুন’।

এটুকু কাজ আপনি নিজে করতে পারলে তো খুব ভালো, নয়তো দালালের কাছে ধারণা দিতে হবে। অবশ্য যদি দালাল ধরে যান, তো দ্রুত কাজ হয়ে যাবে। যেন সব কিছু আগে থেকেই ব্যবস্থা করাই আছে। প্রতিদিন এমন শত শত ঘটনা ঘটে। ৪শ টাকা সরকরি ফি’র বিপরীতে ৪ হাজার টাকা নিলেও তাদের খুশি করা কঠিন। এভাবে তদবির, ঘুস আর অবৈধ লেনদেনের নামে লুট হয় প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা যার ভাগবাটোয়ারা হয় নিচু স্তর থেকে শেষ স্তর পর্যন্ত। অবাক করা বিষয় হলো, এতদিন অবৈধ এসব লেনদেনের বখরা পেয়েছেন সাবেক এমপি ও মন্ত্রীরা। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসার নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল, ছাড়পত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অনুমতি কিংবা প্রত্যায়নপত্র আনতে গিয়ে এমন বহু গল্প জমা আছে ভুক্তভোগী সেবাপ্রত্যাশীদের স্মৃতিতে।

আরজেএসসি: সেবা সহজীকরণ ও দ্রততম সময়ে সেবা নিশ্চিত করতে আরজেএসসি’র সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘শেয়ার হস্তান্তরকারী ব্যতীত অন্য সেবাগ্রহীতাগণকে এ পরিদপ্তরে প্রবেশের প্রয়োজন নেই’। বহু বছর ধরে সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এই অফিসটিতে সৎ কর্মচরীরা টিকতে পারেন না। টিকে থাকতে হলে তাদের হয় ঘুস খেতে হবে নয়তো অন্যত্র বদলি বা চাকরি ছাড়তে হবে। এখানে টেবিল থেকে টেবিলে নথি ঘুরলেই টাকা। প্রতি টেবিলের মালিককেই খুশি করতে হয়। অংশীদারত্ব ফার্ম, বাণিজ্য সংগঠন, সোসাইটি বা কোম্পানি খুলে ব্যবসা করতে চাইলে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নিয়ন্ত্রক।

প্রতিষ্ঠানের নামের ছাড়পত্র, নিবন্ধন, অবসায়ন, সার্টিফিকেট কপিসহ বার্ষিক ও বছরব্যাপী ফাইলিংযের কাজে কোম্পানির ব্যবস্থাপক বা সেক্রেটারিকে আরজেএসসি যেতে হয়। কিন্তু বিনা পয়সায় কোনো ফাইলিং হয়েছে এমন নজির পাওয়া দুষ্কর। নথিতে কোনো সমস্যা না থাকলেও তা ছাড় করতে ইচ্ছে করেই দেরি করেন এখানকার কর্তাব্যক্তিরা। বেশ কয়েক বছর হলো আরজেএসসি’র সেবা অনলাইনে এসেছে। কিন্তু হার্ড কপি জমা থেকে হাই মেলেনি এখনো। আর এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়েছে মানুষকে ঘুস লেনদেন বাধ্য করতে। অবশ্য, হার্ডকপি যেন দিতে না হয় তার জন্য নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়নের কথা শোনা যাচ্ছে অনেকদিন ধরেই। সম্প্রতি আরজেএসসির অসৎ কর্মচারীদের দুর্নীতির ভাগিদার কিছু দালাল অফিসপ্রধান নিবন্ধকের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন বলে জানা গেছে।

যারা অন্যায্যভাবে টাকা আয় করছেন, তারাই পরে নানান ধরনের অপরাধে এই টাকা খরচ করছেন। সমাজে বৈষম্য বাড়াচ্ছেন তারাই। সামাজিক ন্যায্যতাও তাদের কারণেই প্রশ্নের মুখে। তাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যেমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন আর বৈষম্য বিলোপের স্বার্থেই শিল্প ও সেবা খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা করি।

সিটি করপোরেশন/ইউনিয়ন: সিটি করপোরেশনের কমিশনার অফিস বা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে গেলেই বোঝা যায় বাংলাদেশে ব্যবসা করা আসলেই সহজ নাকি গোড়াতেই কঠিন করে তোলা হয়েছে। যদিও বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলাবাহিনী লাগাতারভাবে বলে গেছে বাংলাদেশে ব্যবসা করা আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। ঘরে বসেই নতুন কোম্পানি খোলা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো ব্যবসা শুরু করার মৌলিক অনাপত্তিপত্র ট্রেড লাইসেন্স বাড়তি টাকা না দিয়ে পাওয়া যায় না। অতিরিক্ত টাকা দিতে না চাইলে ভোগান্তি পিছু ছাড়ে না ব্যবসায়ীদের। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবসার পরিবেশ সুগম করতে সবধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলে প্রত্যাশা করা কোনো বিলাসী চাওয়া নয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর: নতুন কারখানা স্থাপন বা পুরোনো ছাড়পত্রের নবায়ন করতে গেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিবেশেটা প্রকৃত অর্থে বোঝা যাবে। এই প্রতিষ্ঠানটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে শর্ত পূরণ না করা প্রতিষ্ঠানকে টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্র দিয়ে শুরুতেই অপকর্মের ভাগিদার হয়। এদিকে কোম্পানি নিজেও শর্ত পূরণ না করেই ছাড়পত্র নিয়ে পরিবেশের ক্ষতি চালিয়ে যেতে থাকে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর ইটিপি না বানিয়ে নদী অথবা নালা-ডোবায় বর্জ্য নির্গত করার মতো বিনাসী কার্যকলাপকে অনুমোদন দেন অথবা দেখেও না দেখার অভিনয় করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের লোভী কর্মকর্তারা। এখনো সারাদেশে বহু ইটভাটা পাওয়া যাবে যেগুলো পরিবেশ আইন মানছে না। যেখানে সেখানে ইটভাটা গড়ে না তোলার ব্যপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও মানছেনা এসব প্রতিষ্ঠান। সুবিধাভোগীদের বেশিরভাগই সরকারদলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে প্রকৃত অর্থেই এসব দেখার যেন কউ ছিল না।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর: কারখানার লে-আউট পরিকল্পনা অনুমোদন, লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন, লাইসেন্সের তথ্য যাচাইসহ আরো অনেক সেবা দিয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো ধরনের হয়রানি ও সময়ক্ষেপণ ছাড়াই সব সেবা কবে কে পেয়েছে? বিশেষ করে বিগত বছরগুলোতে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নতুন কারখানা স্থাপন করলে কর্তাদের খুশি করতেই হবে। শুধু কি তাই, কারখানা চালু হলে শর্ত পালনের চেকলিস্ট ধরে কারখানা পরিদর্শনের যে বিধান আছে তা ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই’ প্রবাদের দশা হয়ে আছে। এক্ষেত্রে সমঝোতার ভিত্তিতে সব নিষ্পত্তি হয়। জনবল, ভবন নির্মাণ, শিশু-কিশোর নিয়োগ, প্রসূতি কল্যাণ, পেশাগত ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তাসহ অনেক বিষয়ই যথাযথভাবে পরিদর্শনের আওতায় না এনেই অনেক ক্ষেত্রে কাজ শেষ করেন পরিদর্শক। শ্রম আইন ও এ সংক্রান্ত বিধির আওতায় ছাড়পত্র দেওয়া হলেও বাস্তবে বহু কারখানায় শোভন কর্ম পরিবেশে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে যায়।
ভূমি অফিস: মফস্বল কিংবা বড় শহর, দীর্ঘদিন ধরেই সব জায়গায়ই ভূমি অফিস যে দুর্নীতির আখড়া, এনিয়ে বিরুদ্ধ মত খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাবেক সরকারের ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমের ফল ভূমি অফিসের অনেক কার্যক্রমই অনলাইনে হয়ে যায়। কিন্তু উপরি টাকা ছাড়া কোনো কাজই যেন হতে চায় না এই অফিসে। সাথে আছে দালালের দৌরাত্ম্য। জমির নামজারি করতে ১১৫০ টাকার ফি কেন এর চেয়ে বেশে লাগবে, টাকা না দিলে ৭ দিনের মধ্যেই কেন হবে না তার জবাবদিহিতার উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসেছে।

বিডা: এতক্ষণ ধরে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানের সেবাপ্রত্যাশীদের যে ভোগান্তির ফিরিস্তি দিলাম, এসবের সহজ সমাধানকল্পে একটা মহৎ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ২০১৬ সালে বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারীকরণ কমিশনকে একীভূত করে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিজস্ব ২৩টি ও অন্য সংস্থার ১০১টি সেবাসহ বর্তমানে ১২৪ ধরনের সেবা প্রদান করতে পারে বিডা। আছে নিবেদিত কর্মকর্তা ও তদারকি দল।

আবেদন করলে নির্ধারিত কর্মবিদস ও কোনো অবৈধ লেনদেন ছাড়াই কাজ হয়ে যাওয়ার কথা। সেবাদানকারী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ফলে দ্রত সময়ে সেবা নিষ্পত্তি করার বাধ্যবধকতা রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ হলো, অনলাইনে আবেদন জমা দিয়ে এরপর সশরীরে হাজির হয়ে উৎকোচ না দিলে নথি নড়াচড়া করে না। কয়েক বছর ধরে টানা ব্যবসা সহজীকরণের ব্র্যান্ডিং করলেও আদতে বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশে উন্নত না হওয়ার পেছনে এটাও অন্যতম একটি কারণ। এসব কারণেই বাংলাদেশ সারা বিশ্বে একটা সম্ভাবনাময় বাজার হওয়া সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।

ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারি সেবা ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা যে উপায়ে ঘুস বা উপরি টাকা আদায় করে তা সভ্যতার কোনো মাপকাঠিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে মনে রাখা দরকার যে সেবা আনতে গিয়ে কোম্পানিগুলো যে বাড়িতে টাকা খরচ করে তা শেষ পর্যন্ত আদায় করা হয় ক্রেতার কাছ থেকেই। ফলে পণ্যের দামও বেড়ে যায়। যারা অন্যায্যভাবে টাকা আয় করছেন, তারাই পরে নানা ধরনের অপরাধে এই টাকা খরচ করছেন। সমাজে বৈষম্য বাড়াচ্ছেন তারাই। সামাজিক ন্যায্যতাও তাদের কারণেই প্রশ্নের মুখে। তাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন আর বৈষম্য বিলোপের স্বার্থেই শিল্প ও সেবা খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা করি।

লেখক: ইব্রাহিম পাঠান, চার্টাড সেক্রেটারি, সংবাদ বিশ্লেষক।

এইচআর/জিকেএস/ফারুক

আরও পড়ুন