বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব: সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম যে অসাধ্য সাধন করতে পারে সেটা বাংলাদেশ সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রত্যক্ষ করেছে। দারুণ সাহসী আর সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে উপেক্ষা করার আর সুযোগ নেই। তাদের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে আধুনিক বিশ্বের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজে লাগাতে হবে। তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতি, বৈষম্য এবং দমন-পীড়ন নীতির বিরোধিতা করে।
সভ্যতার অগ্রযাত্রায় বৈষম্য একটা দারুণ বাধা এবং আমাদের তরুণ নেতৃত্ব রাষ্ট্র ও সমাজের যে কোনো প্রতিষ্ঠানে সেই বৈষম্য দূর করে এবং মৌলিক অধিকার প্রদানে ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের তরুণরা দারুণ মেধাবী, উদ্ভাবনী শক্তিতে ভরপুর, চৌকষ, প্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা এবং খোলামেলা। তাদের সুযোগ এবং নেতৃত্ব প্রদান অগ্রজদের দায়িত্ব। “এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান”- কবি সুকান্তের এই কবিতা এখন দারুণ ভাবে প্রযোজ্য। তরুণদের ‘দায়িত্ব এবং সুযোগ’ দিতে হবে, ‘নেতৃত্বের’ স্থানে বসাতে হবে।
দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ৩৫ বছরের কম যারা তরুণ এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সুযোগ প্রদান করা উচিত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং টেকসই উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য তাদের সমালোচনামূলক চিন্তা, দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সাথে তরুণ প্রজন্মের পরিচিতি তাদের প্রযুক্তি-চালিত বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সহায়ক।
সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা যুব নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে, যেখানে ঐতিহ্যগত পন্থাগুলো উন্নয়নের জন্য অন্তরায় এবং ধীরগতির, সেখানে তরুণ প্রজন্মের দ্বারা নতুন ধারণা গতিশীলতা প্রদান করে। প্রযুক্তি, ব্যবসা বা সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেই হোক না কেন, তরুণ নেতারা সবসময়ই স্মার্ট সমাধানগুলো গ্রহণ করে।
উদ্ভাবন শুধু প্রযুক্তিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি শাসন পদ্ধতি এবং সামাজিক পর্যায় পর্যন্ত প্রসারিত। তরুণ নেতারা সামাজিক সংগঠন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার জন্য নতুন পদ্ধতির পথপ্রদর্শক। তরুণদের গতানুগতিক ধারার বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা, বাংলাদেশের অবকাঠামো আধুনিকীকরণ, শিক্ষার উন্নতি এবং সেবামূলক খাতের উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো দুর্নীতি, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষুণ্ণ করে, বৈষম্য বাড়ায় এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করে। তরুণ প্রজন্মের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতি দুর্নীতি দমনে একটি শক্তিশালী শক্তি হতে পারে। তরুণ নেতারা প্রায়শই বেশি আদর্শবাদী এবং কম দুর্নীতিগ্রস্ত, ফলে তাদের সততা এবং নৈতিকতা রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিক ভূমিকা রাখে।
ক্ষমতা এবং অর্থ-বিত্তের লোভ, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পদবি পাওয়ার আশা তরুণ প্রজন্মকে তাদের মূলধারার চিন্তা চেতনা এবং দেশ গঠনের সুস্থ নেতৃত্ব থেকে যেন দূরে নিয়ে না যায় সে দিকেও বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
বিশ্বের যে সব দেশে তরুণ নেতৃত্ব আছে সেখানে তারা বেশি প্রতিযোগিতামূলক কাজ করে, কারণ তারা পরিবর্তনের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী সহযোগিতায় বন্ধু সুলভ আচরণ করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, তরুণ কূটনীতিক বা নেতারা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করে বিশ্বব্যাপী যুবদের সাথে আরও ভালোভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। বাংলাদেশর ক্ষেত্রে, তরুণ নেতৃত্ব অন্য দেশের সাথে এবং বৈশ্বিক ফোরামে দ্রুত সম্পর্ক জোরদার করতে পারে।
তরুণ প্রজন্মের নেতাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পুরোনো নেতাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের ধারাবাহিকতা, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য এই দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা এ ব্যাপারে যেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন:
• মেন্টরশিপ এবং নলেজ ট্রান্সফার: পুরোনো রাজনৈতিক নেতাদের উচিত তরুণ নেতাদের তাদের অভিজ্ঞতা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরামর্শ দেওয়া। এটি নতুন প্রজন্মকে শাসন ও নীতি-নির্ধারণের জটিলতা বুঝতে সাহায্য করে। অভিজ্ঞ নেতারা তরুণ রাজনীতিবিদদের সরকারি কার্যক্রমের জটিলতা, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক নীতি মেনে চলার গুরুত্ব বোঝার জন্য গাইড করতে পারেন।
• তরুণ নেতাদের জন্য স্থান তৈরি করা: সিনিয়র নেতাদের ক্রমান্বয়ে উদীয়মান নেতাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা উচিত, যাতে তারা বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং আস্থা অর্জন করতে পারে। এতে দলীয় কার্যক্রম, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনী প্রচারণায় নেতৃত্বের ভূমিকা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তরুণ নেতাদের দ্বারা প্রস্তাবিত উদ্যোগ এবং নীতিগুলো উৎসাহিত করা এবং সমর্থন করা তাদের ধারণাগুলো বাস্তবায়নের এবং তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে শেখার প্ল্যাটফর্ম দিতে পারে।
• নৈতিক নেতৃত্বের প্রচার: পুরোনো রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিক আচরণের মডেল করার দায়িত্ব রয়েছে, তরুণ নেতাদের সততা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার গুরুত্ব দেখানো। তাদের উচিত সক্রিয়ভাবে দুর্নীতিবাজদের নিরুৎসাহিত করা এবং নৈতিক শাসনের সংস্কৃতির প্রচার করা। সিনিয়র নেতাদের জোর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে রাজনীতি জনগণের সেবা করা, ব্যক্তিগত লাভ নয়। তাদের উচিত তরুণ নেতাদের তাদের ভোটারদের কল্যাণ এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করা।
• রাজনৈতিক শিক্ষা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করা: পুরোনো নেতাদের নিশ্চিত করা উচিত যে তরুণ রাজনীতিবিদদের শিক্ষাগত সংস্থান, প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং রাজনৈতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোতে অ্যাক্সেস রয়েছে, যা জননীতি, কূটনীতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মতো ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতা বাড়াতে পারে। তাদের উচিত নতুন নেতাদের ক্রমাগত শেখার এবং পেশাগত উন্নয়ন, বৈশ্বিক প্রবণতা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং উদ্ভাবনী শাসন মডেল সম্পর্কে আপডেট থাকতে উৎসাহিত করা।
• নেটওয়ার্ক এবং কোয়ালিশন তৈরি করা: সিনিয়র রাজনীতিবিদরা নতুন নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। এই সংযোগগুলো তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য এবং দেশকে উপকৃত করে এমন অংশীদারত্ব বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরোনো এবং নতুন নেতাদের মধ্যে সহযোগিতার প্রচার আরও শক্তিশালী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উদ্ভাবনের সাথে অভিজ্ঞতার মিশ্রণের দিকে পরিচালিত করতে পারে। এটি ক্ষমতা এবং দায়িত্বের একটি মসৃণ স্থানান্তরও নিশ্চিত করে।
• গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে উৎসাহিত করা: সিনিয়র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উচিত তরুণ নেতাদের সহনশীলতা, বহুত্ববাদ এবং বিভিন্ন মতামতের প্রতি শ্রদ্ধার মতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা। সামাজিক সম্প্রীতি এবং কার্যকর গণতন্ত্র বজায় রাখার জন্য এটি অত্যাবশ্যক। তাদের উচিত তরুণ নেতাদের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনায় যুক্ত হতে এবং সহিংসতা ও চরমপন্থা এড়াতে নির্দেশনা দেওয়া। এর মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সংলাপ, সমঝোতা এবং বোঝাপড়ার প্রচার জড়িত।
• প্রজন্মের মধ্যে ব্যবধান কমানো: তরুণ নেতারা পুরোনো এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে, অতীতের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা যাতে হারিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করে, পাশাপাশি নতুন ধারণা এবং পদ্ধতির সাথে এগিয়ে যেতে পারে। এই ভারসাম্য উদ্ভাবনী এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নীতি তৈরির জন্য অপরিহার্য।
তরুণদের সব রকমের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের তরুণ নেতৃত্বে কার্যকর করার ক্ষেত্রে বেশ কিছুর বাধা রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রায়ই পুরানো প্রজন্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়, যারা ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বা নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক। একবার ক্ষমতায় এলে আর ছাড়তে চায় না। এই প্রজন্মগত ব্যবধান তরুণদের নেতৃত্বে আসার অন্তরায়।
উপরন্তু, নেতিবাচক পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি ক্ষমতার লোভ তরুণ যোগ্য নেতাদের উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করে। এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থাগুলোতে যুব কোটা প্রবর্তন এবং তরুণ নেতাদের সংযুক্ত করে এমন পরামর্শদান কর্মসূচির প্রতিষ্ঠা সহ নেতৃত্বে তরুণদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকা দরকার।
তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করার জন্য, বাংলাদেশকে অবশ্যই সব সেক্টরে নেতৃত্বের ভূমিকায় তরুণদের একীভূত করার জন্য সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তরুণদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার জন্য সুযোগ করতে হবে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বের সুযোগ এবং স্থান দেওয়া ভবিষ্যতের জন্য শুধু একটি বিনিয়োগ নয়- এটি জাতির অব্যাহত অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। একটি আধুনিক, দুর্নীতিমুক্ত এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে দেশকে চালিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা এবং প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের তরুণদের রয়েছে। তরুণ নেতাদের ক্ষমতায়ন এবং জাতীয় নেতৃত্বে তাদের একীভূত করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি, উদ্ভাবন এবং সামাজিক পরিবর্তনের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে, যাতে আগামী বছরগুলোতে তার জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত তার ব্যবস্থা করতে হবে।
অন্যদিকে, ক্ষমতা এবং অর্থ-বিত্তের লোভ, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পদবি পাওয়ার আশা তরুণ প্রজন্মকে তাদের মূলধারার চিন্তা চেতনা এবং দেশ গঠনের সুস্থ নেতৃত্ব হতে যেন দূরে নিয়ে না যায় সে দিকেও বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা
এইচআর/ফারুক/জিকেএস