আলামত ভালো নয়
বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন ১৯৭৫-এ। একা নয় সপরিবারে। সেবারে তাঁর দুই কন্যা প্রাণে বেঁচে যায় বিদেশে অবস্থান করার কারণে। পরে ১৯৮১ সনে জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে দলের হাল ধরেছেন। ৭ বছরের মাথায় বিরোধী দলের নেত্রী হয়েছেন। ১৯৯৬ সনে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তাঁর ওপর দুই দফা হামলা চালানো হয়- কোটালিপাড়া ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভেন্যুতে। ২০০৪ সনের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় দলের নেতা-কর্মীদের তৈরি মানববেষ্টনির সহায়তায় প্রায় অলৌকিকভাবে তিনি প্রাণে রক্ষা পান। তাঁর প্রাণহানির শঙ্কা তা বলে কেটে যায় নি।
সম্প্রতি শেখ হাসিনার পুত্র অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রকে যুক্তরাষ্ট্রে অপহরণ ও হত্যার একটি ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনের খবর বেরিয়েছে। এফবিআইয়ের দায়ের করা মামলায় দু’ জনের শাস্তি হয়েছে, যাঁদের একজন বাংলাদেশী। দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুসহ তিন প্রজন্ম হত্যা ষড়যন্ত্রের আশঙ্কার মধ্যে ছিলেন, আছেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ-নাশে ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়েছে। পরের দুই প্রজন্ম প্রাণে রক্ষা পেলেও ষড়যন্ত্র যে চলছে তা পরিষ্কার। এখন যদি আমরা এ ষড়যন্ত্রের সুবিধাভোগীদের দিকে তাকাই এবং এসব মামলার অভিযোগপত্রে যাদের সংশ্লিষ্টতার কথা জানা যাচ্ছে তাদের পরিচয় খুঁজি তাহলে কি দেখি? সেখানে কি একটি সাধারণ ঐক্যসূত্র পাওয়া যাচ্ছে? দেখা যাক।
বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার প্রত্যক্ষ সুবিধা ভোগ করেছেন দু’জন- খন্দকার মোশতাক এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান। নারকীয় জেলহত্যার কলকাঠি যে মোশতাক সক্রিয়ভবে নেড়েছেন তা সবার কছে পরিষ্কার। তবে তিনি যে এতটা বিশ্বাসঘাতকতা করেও মূল হত্যাকারীদের প্রকৃত বিশ্বাসভাজন ছিলেন না তাও অস্পষ্ট নয়। বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যার মূল নায়কগণ সামরিক বাহিনীর তৎকালীন দ্বিতীয় ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের কাছ থেকেই সহায়তা প্রত্যাশা করেছিল। জিয়া ঘটনাচক্রের ভিতর দিয়ে এক চরম অস্থির পরিস্থিতিতে ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসেন। তখনকার মত অস্থির অনিশ্চিত পরিস্থিতি তিনি সামলেছেন ঠিকই কিন্তু খুনিদের প্রতি তাঁর আচরণ একজন ন্যায়বান সুশাসকের ছিল না, ছিল সহানুভূতিশীল ব্যক্তির। তিনি তাদের নিরাপত্তার সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথমে তাদের দেশত্যাগে সহায়তা দিয়েছেন, প্রবাসে স্থিতি ও নিরাপত্তার জন্যে সঙ্গে পরিবার নিতে এবং প্রত্যেককে সরকারি চাকুরি দিয়েছেন। একে পুরস্কৃত করা বলা যেতে পারে।
সর্বশেষ পুতুল সরকার খন্দকার মোশতাকের জারিকৃত ইনডেমনিটিড অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অংশ করে তাদের দায়মুক্তি ও নিরাপত্তা স্থায়ীভাবে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। কেন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে স্বীকৃত খুনিদের সাথে আপোস করলেন? রাষ্ট্রকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি লালনে বাধ্য করেছেন? এসব প্রশ্নের হাত থেকে দল ও দলের রাজনীতিকে কীভাবে রক্ষা করবেন সেটা ভাবা বিএনপির নেতৃত্বের জন্যে জরুরি। এবারে আমরা যদি শেখ হাসিনার জীবনের ওপর হামলাগুলো বিচার করি, তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর দিকে তাকাই তাহলে যাদের নাম উঠে আসে তাদের প্রতি বিএনপির কোনো না কোনো মহলের প্রশ্রয়ের তথ্য পাওয়া যায়- বিএনপি ক্ষমতায় থাকুক বা ক্ষমতার বাইরে থাকুক। এসব ঘটনা তো জনগণ দেখছে।
এবারেও প্রধানমন্ত্রীপুত্র অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের সদস্য এবং উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে আওয়ামী রাজনীতির সম্ভাব্য ভবিষ্যত প্রধান ব্যক্তি জয়ের অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনায় বিএনপি রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু নাম এসেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের শীর্ষ বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যার সাথে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বা বিএনপি সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকের নাম উঠে এলে মানুষ কী বারতা পাবে?
প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ে হত্যা, গুম, খুন, জখম, হামলা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে এন্তার। কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার অভিযোগ কখনও বা এখনও ওঠে নি। বরং এযাবৎ পাকিস্তান আমল থেকে সরকার, সরকারি দল বা ক্ষমতাবান প্রতিপক্ষের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে বরাবর এই দল। এমনিতেই রাজনীতিতে কালোটাকা ও অস্ত্রের ব্যবহার, রাজনীতির মধ্যে খুনজখমসহ মারাত্মক অপরাধ স্থান করে নেওয়ায় দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি সংকটে রয়েছে। এখন অপর প্রধান দল বিএনপি যদি এভাবে চিহ্নিত হতে থাকে তাহলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কীভাবে ধারাবাহিকতার সাথে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে? আমরা গত কিছুকাল ধরে একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির ধারাবাহিক অবক্ষয় ও সংকট লক্ষ্য করছি। এটা দেশের গণতন্ত্রের রাজনীতির জন্যে সুখবর নয়।
এটা সবাই দেখছেন বিরাজমান শূন্যতায় কীভাবে ক্ষমতাসীন দল অনেকটা ক্ষমতার জোরে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য সংহত করে নিচ্ছে। তারা তেমনভাবে কোনো দিকেই তাকাচ্ছে না, আইন ও নিয়মেরও তোয়াক্কা করছে না, বর্তমান ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার একেবারে নিচের স্তরেও সর্বাত্মক দখল কায়েম করতে যাচ্ছে। বোঝা যায় বিএনপিকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে এবারে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রার্থীদের দলীয় পরিচয়ে হচ্ছে। এতে নির্বাচনের সকল পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ তথা সহায়তায় সরকার সুবিধাজনক ফলাফল আদায় করে নিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে দলীয় নির্বাচনের ফলে সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার শংকা দেখা দিয়েছে। ইউপি নির্বাচনে ভোটারদের কাছে সাধারণত দলের চেয়ে প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতাই গুরুত্ব পেত। কারণ আখেরে মানুষ ঘরে-সংসারে-সমাজে একটু শান্তি-স্বস্তিতে জীবন কাটাতে চায়। কিন্তু এখন দলীয় রাজনীতির বিভেদ ও সংঘাতের আঁচ গ্রাম ছাপিয়ে পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। সমাজে নির্বাচন ঘিরে যে অস্থিরতা-সহিংসতা তৈরি হচ্ছে তা সহজে মিটবে না। সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনের শান্তি-স্বস্তি দীর্ঘ মেয়াদে হারাতে বসছে কিনা জনমনে সেই শংকা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি চোখে পড়ছে, সমস্ত সূচকেই অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু বিপরীতে গণতন্ত্রের দিক থেকে অবনতি জোরকদমে চলছে। এর বড় দায় বিএনপিকে বইতে হবে ভুল রাজনীতি আঁকড়ে থাকার জন্যে। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা একদম চলে যাচ্ছে। এতে বড় ক্ষতি হবে বাঙালির হাজার বছরের যে উদার মানবতার ঐতিহ্য তা হারিয়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে চরমপন্থী ধর্মান্ধ, জঙ্গিবাদ বাড়তে থাকবে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিবেশে জ্ঞানভিত্তিক অগ্রসর সমাজ প্রতিষ্ঠা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বিএনপিকে বাংলাদেশের বাস্তবতা অনুযায়ী এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির চাহিদা পূরণ করেই রাজনীতির কথা ভাবতে হবে। ষড়যন্ত্র বা অন্য কারো ঘাড়ে বন্দুক রেখে লাভবান হওয়ার চিন্তা বাদ দিতে হবে। আবার বিএনপি এবং জঙ্গিবাদ-ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ঠেকানোর নামে সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে আওয়ামী লীগকে। এদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে উদার মানবতাবাদী, তাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল মূলত উদার গণতন্ত্রের জন্যে। তাই এখানকার মানুষ ধর্মান্ধ চরমপন্থা বা ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি যেমন নেবে না তেমনি যে কোনো ধরনের ফ্যাসিস্ট রাজনীতির প্রবণতাকেও গ্রহণ করবে না। এসব কখনো কোনো দেশেই মঙ্গলজনক ফল বয়ে আনে নি।
সত্যিই, উন্নয়নের এই সুসময়ে মানুষ নিরুদ্বেগ আনন্দে ভাসতে পারে না, মনের কোণে আশংকার কালোমেঘ ভালোভাবেই জমছে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ
এইচআর/আরআইপি