ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সামাজিক কাঠামো, পারিবারিক বন্ধন, মূল্যবোধ কি অর্থহীন?

প্রকাশিত: ০৪:১৪ এএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৬

`স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন’, এমন শিরোনাম খুব সাধারণ বাংলাদেশে। কিন্তু হঠাৎ করে ‘মা’র হাতে সন্তান খুন’ প্রায় নিয়মিত শিরোনাম হয়ে উঠছে। সভা সেমিনারে, টকশোতে বিশিষ্টজনেরা বলছেন নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পরিবারিক-বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে ‘যান্ত্রিক` জীবনে বাড়ছে অস্থিরতা ও হতাশা। এমন প্রেক্ষাপটেই সমাজে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চরম হয় এবং খুন-খারাবির মতো ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।

একবিংশ শতকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘সম্পর্ক’ এর ধ্যানধারণা বাঙালি নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছে নতুনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। কি ধনবান, কি সাধারণ খেটে খাওয়া, নিম্নমধ্যবিত্ত গণ্ডিতে বা গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় থাকা পরিবার, সবখানেই অস্থিরতা। এক দুই যুগ আগেও মানুষের আশা-আনন্দ-বিনোদনের কেন্দ্র জুড়ে ছিল পরিবার। এখন পারিবারিক সম্পর্কগুলো খুব ঠুনকো, খুব অনাত্মীয়ধর্মী। মানুষ অনেক বহির্মুখী। জীবনের ধারণায় আকাশপাতাল বদল এসেছে। পরিবারের গণ্ডিতে বাঁধা পড়তে মানুষ আর অতটা স্বচ্ছন্দ নয়। সে স্বাধীনচেতা। তার উচ্চাশা কাড়ছে, জীবন ধারণে ঔজ্জ্বল্য চায়, কেনাকাটায় ব্র্যান্ড চায়, আয় ইনকাম যাই হোক ফ্ল্যাট চায়, গাড়ি চায়।

উত্তরায় কিংবা বনশ্রী, বা দেশের আরেক প্রান্তে যেখানেই বাবা-মায়েদের মানসিক উদ্বেগ আর টানাপোড়েনে সন্তান খুনসহ সাঙ্ঘাতিক সব ঘটনা ঘটছে সেগুলোর একটা বড় কারণ এই অতি চাওয়া। সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ভোগবাদি ভাবনা কি দায়িত্বহীনতা নয়? স্বার্থপরতা নয়? সামাজিক কাঠামো, পারিবারিক বন্ধন, মূল্যবোধ কি তা হলে অর্থহীন?

আসলে পারিপার্শ্বিকটাই বদলে যাচ্ছে। বহু বিয়ে টিকছে না। চারদিকে অসুখী দাম্পত্য, ভাঙা সম্পর্ক, সন্তান মানুষ করা নিয়ে ব্যস্ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টানাপোড়েন। পাশাপাশি, সামাজিক জীবনের চাহিদা বদলে যাচ্ছে। শুধু চাওয়া আর চাওয়া। পাওয়া হয় কতটুকু?

বেশ কিছু অদ্ভুত নৃশংসতা বা উচ্ছৃঙ্খলতা মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে, শঙ্কিত করছে। সিলটের রাজন, খুলনার রাকিব নামের শিশুদের নির্যাতন করে হত্যা যেমন সমাজকে নাড়া দিয়েছে, তেমনি আলোড়িত করেছে পঞ্চায়েতের আদিপত্যের জন্য মাটি চাপা দিয়ে হবিগঞ্জে চার শিশুর হত্যার ঘটনাটি। বিত্তবান পরিবারের ছেলে জুনায়েদ নামের এক বখে যাওয়া ছেলের ঘটনা আমাদের মর্মকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে তার বন্ধুর সঙ্গে শুধু উন্মত্ত তাণ্ডব চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তা আবার ভিডিও করেছে।

এমনই অমানবিকতা  আর হিংস্র মনোভাব নিয়ে কত তরুণ বেড়ে উঠছে। আর না হওয়ারও তো কারণ দেখি না, কারণ পারিবারিক মূল্যবোধগুলো বিনষ্ট হওয়ার পথে। এই প্রজন্ম বেড়ে উঠছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠদের অনৈতিকতা, দুর্নীতি ও মিথ্যাচার দেখে। আমাদের প্রজন্ম শিশু বেড়ে উঠছে ভেজাল খাবার খেয়ে, দূষিত আবহাওয়া আর অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির মধ্যে। বড় হয়ে উঠছে ধর্মীয় উন্মত্ততা দেখে, ধর্মের নামের ভণ্ডামি দেখে। যাদের বয়স এখন ১৫ থেকে ১৮ এর মধ্যে তারা দেখছে বড়রা কিভাবে চুরি করছে, দুর্নীতি করছে, কিভাবে ভোট জালিয়াতি করে নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে। সবই শিখছে প্রজন্ম এবং খুব সরবে এক সময় এই শিক্ষা সমাজকে দেখিয়েও দিবে।

আমরা এক ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি, পাশ্চাত্যের মূল্যবোধগুলোর আংশিক বা বিকৃতভাবে গ্রহণ করছি আমরা। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের বিস্তার ঘটছে। মা বা বাবা কোনো অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে সন্তানরা তা জেনে গেলে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। একসঙ্গে একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরাও। চারপাশে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। ক্ষমতায়ন বা স্বাধীনতার সঠিক ধারণা না থাকায় এগুলোর অপব্যবহার করা হচ্ছে। মাদকের প্রভাবের কারণে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। মাদকাসক্ত মা বা বাবা সন্তানকে মেরে ফেলছে। রয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। দ্রুত ধনী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। সামাজিক ন্যায় বিচার, অনুশাসন কিছুই কাজ করছে না। ক্রান্তিকালীন সব সমাজেই এই ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিকট বিকাশে এই অস্থিরতা আরো বাড়ছে। শৃঙ্খলার বাইরে থাকাটাই হয়ে উঠছে স্মার্টনেস। নগরায়ণ, প্রযুক্তি গত পরিবর্তন, সামাজিক বন্ধনে অসঙ্গতি আমাদের মানবিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ভেঙে পড়েছে। পরিবারের শাসন উবে গেছে সেই কবে। রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অভাব সামাজিক কাঠামো নিয়ম শৃঙ্খলাকে ভেঙে দিচ্ছে এমন করে যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে আসছে।

ভোগবাদী সংস্কৃতিটা বাড়ছে এমন করে যে, মানুষ কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হতে গিয়ে খুন খারাবি করছে।

ফেরার পথ কী? আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। তাহলে ভাববেন কারা?  সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে সঙ্গী, বন্ধু ও সহকর্মী হয়ে উঠুক আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা। প্রজন্মকে ফেরাতে হবে আলোর পথে।

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন