ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ঘূর্ণিঝড় রিমাল

দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান

এরশাদুল আলম প্রিন্স | প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ২৮ মে ২০২৪

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। প্রায় সারাবছরই এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগে থাকে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ও ভাটি অঞ্চলে আমাদের অবস্থান হওয়ায় এমন দুর্যোগ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে কয়েকটি দেশ সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী বাংলাদেশ তাদের প্রথমদিকেই অবস্থান করছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে আমরা বিশ্বের মধ্যে সপ্তম দুর্যোগঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত।

মূলত সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলোই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। কিন্তু এগুলোর প্রভাব মোকাবিলায় আমরা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারি।

আমরা দাবি করছি, দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি কী সেটা আলোচনা সাপেক্ষ।

সময়ের বিবর্তনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে। এক সময়ে আবহাওয়া অফিসেরও পূর্বাভাস জানার জন্য আজকের মতো প্রযুক্তি ছিল না। সেই পূর্বাভাস মানুষের কাছে পৌঁছানোর মতো আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিও ছিল না। রেডিও ও সংবাদপত্রই ছিল একমাত্র প্রচারমাধ্যম। সবার কাছে রেডিও ও ছিল না। গভীর সমুদ্রে সেই রেডিও বার্তা শোনা যাবে এমন ফ্রিকোয়েন্সিও ছিল না। আজ দেশের নদীগুলোর দুই তীর ঘিরে রয়েছে শত শত মোবাইল টাওয়ার। রেডিও অনেক আগেই বিলিন হয়েছে। নদীপথে চলাচলকারী যাত্রী ও জেলেদের হাতের মুঠোয় আজ মোবাইল ফোন। সবাই যোগাযোগের আওতায়। গভীর সমুদ্র বন্দরেও রয়েছে যোগাযোগের ব্যবস্থা। রয়েছে নৌ বাহিনীর টহল জাহাজ। ঝড়ের আগেই সবাইকে তীরে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে তারা। রয়েছে কোস্ট গার্ড। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ আজ আগের চেয়ে অনেক সচেতন। দুর্যোগে আজ যে ক্ষয়ক্ষতি কম হচ্ছে তার প্রধান কারণই হচ্ছে মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। মানুষ আগে থেকেই আবহাওয়া পূর্বাভাস জানতে পারছে। পূর্বাভাস জানার জন্য আজ আর তাদের দেশের আবহাওয়া দপ্তরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে না। মোবাইলে মোবাইলে রয়েছে আবহাওয়া জানার নানা অ্যাপস।

মানুষ এখন আগে থেকেই নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারছে। সমুদ্র বা নদী তীরবর্তী অঞ্চল থেকে মানুষ অধিকতর নিরাপদ মূলভূমিতে আশ্রয় নিতে পারছে। এছাড়া সরকার উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছে। মানুষ আগের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হয়েছে। ফলে তাদের ঘরবাড়ি স্থাপনা আগের চেয়ে উন্নত ও টেকসই হয়েছে। গ্রামে এখন ছনের ঘর দেখা যায় না। বাশের খুটির ঘর আর আজ আর নেই বললেই চলে। উত্তরাঞ্চলে যদিও এখনও মাটির ঘর আছে। কিন্তু ছনের ঘর প্রায় নেই বললেই চলে। বাশ বা কঞ্চি দিয়ে ঘরের চাল আজ অতীত। বসতবাড়ির গাঁথুনি আগের চেয়ে অনেক শক্ত।

আগে কালবৈশাখী ঝড়েও গ্রামের বহু ঘর বাড়ি উড়ে যেতো। শৈশবে আমি গ্রামে ছিলাম। কালবৈশাখের সন্ধ্যাগুলো ছিল আমাদের জন্য আতঙ্ক। মা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে গুটিশুটি দিয়ে ঝড়ের সময় ঘরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায়টায় নিয়ে বসে থাকতো। আমাদের ঘরের অবস্থা ছিল খুবই নড়বড়ে। গ্রামের অধিকাংশ ঘরবাড়ির একই অবস্থা ছিল।
আজ সেসব দিন অতীত। দুর্যোগের সময় মানুষ আসলে তার আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনেরই ইতিবাচক ফলাফল দেখতে পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুফল। ফলে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি কম হচ্ছে। একেই আমরা বলছি ‍দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমরা কি কিছু করছি? উপকূলে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করাকেই কি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বলে?

তবে যেকোনো কারণেই হোক না কেন, সার্বিকভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতা আগের তুলনায় বহুলাংশে বেড়েছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক প্রকল্পের আলোকে সরকার ডিজাস্টার অ্যাক্ট, স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অব ডিজাস্টার, ন্যাশনাল প্ল্যান ফর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টসহ নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এছাড়া দুর্যোগঝুঁকি অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপরও সরকার জোর দিয়েছে। জলবায়ু তহবিল নিয়ে নয়-ছয় করার পরেও কিছু কাজ হচ্ছে। মানুষ তার সুফলও পাচ্ছে।

দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন সব সময়েই তৎপর থাকে। এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক দিক। মানুষ দুর্যোগের সময় প্রশাসনকে পাশে পায়। দরিদ্র ও দুর্যোগপ্রবণ জনপদে এরকম একটি মানবিক প্রশাসন অনেক বড় শক্তি। দুর্যোগের সময় মনোবলই এক বড় শক্তি। এ সময়ে স্থানীয় স্কুল-কলেজ আগে থেকেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মানুষ আগে থেকেই এগুলোতে এসে আশ্রয় নিতে পারে। তবে, আগে তৈরি করা স্কুল-কলেজগুলোকেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে যাতে ব্যবহার করা যায় সে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সরকারি প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় এলাকায় বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজগুলোও যাতে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় সে ব্যবস্থা যেতে পারে। সেজন্য কিছু টয়লেট প্রতিষ্ঠা, খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করা, কিছু রান্না করার জায়গার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পুরনো অবকাঠামোর কিছু পরিবর্ধনের ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। এতে খরচও কম হবে। নতুন একটি আশ্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে যা খরচ তার চেয়ে বহুগুণ কম খরচে একটি পূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে এগুলোকে ব্যবহার করা যাবে।

শুধু ঘূর্ণিঝড়ই দুর্যোগ নয়। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিও দুর্যোগ। জলোচ্ছ্বাসও দুর্যোগ। একেক দুর্যোগে একেক প্রস্তুতি। শহরে এক ধরনের প্রস্তুতি, গ্রামে আরেক ধরনের প্রস্তুতি। একদিকে আমরা উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করছি। অন্যদিকে শহরে দুর্যোগ মোকাবিলায় কোনো খবর নেই।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল দুর্বল হয়ে দেশের ভূখণ্ড অতিক্রম করেছে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলো যে বৃষ্টিতে ডুবে গেলো সে নিয়ে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। শুধু রিমাল কেন, বর্ষাকালে একটু স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেই ঢাকা শহর তলিয়ে যায়। এ নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি কী? চট্টগ্রামেরও অবস্থা একই। অন্যান্য শহরগুলো হয়তো এখনো ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো এতোটা ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি তাই সেসব শহর এখনও বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায় না। কিন্তু এখনই পরিকল্পনা না নিলে সব শহরকেই একই পরিণতি বরণ করতে হবে। জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে না পারলে আমরা হয়তো ডুবিয়া মরিবো, মরিয়াও ডুবিবো!

আমাদের নগর পরিকল্পনায় আছে শুধু ইট-পাথরে দালান আর বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ। এ পরিকল্পনার মধ্যে জলাশয় নেই। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। দোতলা তিনতলা রাস্তাঘাট নির্মাণ করছি অথচ নিচ তলার রাস্তা ডুবে আছে কোমর পানিতে। সামান্য বৃষ্টিতে ঘরের সামনে হাঁটু পানি। বিষয়টি যেন পানির নিচে রাস্তা ভালো অবস্থা!

হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে পুর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এর উপযোগীতা ও সৌন্দর্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সত্যি অসাধারণ এর সৌন্দর্য। মন ভরে যায়, চোখ জুড়িয়ে যায়। এ সড়কের পাশ দিয়ে একটি ছোট লেকও রয়েছে। লেকটি সুন্দর সন্দেহ নেই। তবে এটিকে জলপরিবহনের জন্য উপযোগী করা হলে তা কতোই না ভালো হতো। এটিকে আরেকটু প্রশস্ত করলেই সেটি সম্ভব ছিল। এখন এ লেকটি শুধুই সুন্দর, এর অন্য কোনো উপযোগিতা নেই। এগুলো পরিকল্পনাগত ত্রুটি।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো তাদের জলাধারগুলো পরিচ্ছন্ন করে ব্যবহারোপযোগী করছে। অথচ আমরা শহরের সব জলাশয় ধ্বংস করে দালান নির্মাণ করছি, রাস্তা বড় করছি। অন্যান্য শহর তাদের পার্শ্ববর্তী নদীগুলোকে প্রবহমান করছে। সে সব নদীপথে বিপুল সংখ্যক যাত্রীও চলাচল করে। নদীগুলোর পানিও স্বচ্ছ, দূষণ নেই। আমাদের ঢাকাও একসময় নদীবেষ্টীত ছিল। কিন্তু আজ ঢাকায় নদীতো অনেক পরের কথা, ডোবাও নেই। এ অবস্থায় নগরের দুর্যোগ মোকাবিলা করা যায় না। আমাদের নাগরিক দুর্যোগ মোকাবিলায়ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, শহরেই অধিকাংশ মানুষের বাস। শহরকে উপেক্ষা করে দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতার দাবি অলীক ও অবাস্তব।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল সহসাই চলে যাবে। আশা করি উপকূলবর্তী অঞ্চলেও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে না। কিন্তু ঢাকা এই রিমালের প্রভাবে ইতোমধ্যে এক জলমগ্ন মহানগর। কাজেই, দুর্যোগ মোকাবিলা একটি পরিপূর্ণ বিষয়। একে আংশিকভাবে দেখার সুযোগ নেই।

কাজেই, আমাদের দুর্যোগ পূর্ববর্তী, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী প্রস্তুতির ওপর জোর দিতে হবে। দেশেজুড়েই এ প্রস্তুতি নিতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগ আরও বাড়বে বই কমবে না। সেটা কখনো আশা করি না। কিন্তু সে প্রস্তুতি আমাদের নিতে হবে। উপকূলে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণের ওপর জোর দিতে হবে। স্থানীয় জনগণকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেজন্য উপকূলবর্তী এলাকায় অবকাঠামো সরঞ্জামের ওপর বিশেষ মূল্য ছাড়ের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। কার্যকর উদ্ধার তৎপরতায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। আসলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। স্থানীয় অংশীজনদের কাজে লাগাতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় এদেশের যারা বিশেষজ্ঞ তাদের গবেষণা ও মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষকে সাথে নিয়েই যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। সেটা উপকূল হোক অথবা এই ঢাকা মহানগর।

লেখক: আইনজীবী, প্রাবন্ধিক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন