ঈদ-নববর্ষের পর নির্বাচনী উৎসব
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর, তার দুদিন পর বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ- সব মিলিয়ে বাংলাদেশ গত সপ্তাহটি পার করেছে উৎসবমুখরতায়। ব্যাক টু ব্যাক এমন উৎসব খুব একটা মেলেনা। এমনিতেই ঈদের ছুটিতে মানুষ গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায়। এর মাধ্যমে আসলে উৎসবের আনন্দটাই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ঈদের পরপরই বর্ষবরণ, এবার দেশজুড়ে ডাবল আনন্দ হয়েছে। তবে যারা ঢাকায় ছিলেন, তাদের আনন্দটা হয়েছে ট্রিপল। একে তো দুইটা উৎসব, তারওপর ঢাকা ফাঁকা।
ব্যাক টু ব্যাক দুইটা উৎসবে এবার সবাই লম্বা ছুটি পেয়েছেন। সেই ছুটির আমেজ অবশ্য শুরু হয়েছিল আরো এক সপ্তাহ আগে থেকেই। আগের সপ্তাহের সাপ্তাহিক ছুটির সাথে শবে কদরের ছুটি মিলিয়ে তিনদিন হয়ে গিয়েছিল। যারা মাঝের দুদিন ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছিলেন, তারা লম্বা ছুটি পেয়েছেন। মাঝের এই দিন দশেক ঢাকা ছিল অনেকটাই অচেনা। চিরাচরিত যানজট নেই, হৈচৈ নেই, কোলাহল নেই। এমনিতে দুই কোটি লোকের চাপে পিষ্ট ঢাকাকে বিশাল মনে হয়। কিন্তু ঈদের ছুটিতে ঢাকাকে কেমন অচেনা লাগে, অসহায় লাগে। এত বড় শহর, এত যার দাপট; ২০ মিনিটেই এ মাথা ও মাথা করা যায়।
লম্বা ছুটি শেষে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, শেয়ারবাজার খুলছে। তবে পরপর দুটি উৎসবের রেশ রয়ে গেছে এখনও আকাশে বাতাসে। আমার ধারণা, এই সপ্তাহটাও দুলকি চালেই চলবে ঢাকার জীবন। আগামী সপ্তাহ থেকে ঢাকা ফিরবে আসল চেহারায়।
তবে ঈদ আর পহেলা বৈশাখের উৎসবের রেশ থাকতে থাকতেই বাংলাদেশে বেজে উঠেছে আরেক উৎসবের ঢোল। এ উৎসব নির্বাচনের। বাংলাদেশে নির্বাচন ছিল সবচেয়ে জমজমাট ও বর্ণাঢ্য উৎসবের নাম। তবে গত কয়েকবছরে বাংলাদেশে নির্বাচনী উৎসবের রঙ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না অনেকদিন ধরেই। আগে থেকেই ফলাফল নির্ধারিত থাকে বলে ভোটাররাও কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হন না। নির্বাচন অনেকটাই পাতানো খেলা হয়ে গেছে। পাতানো খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ আনতে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের মাঠ বিদ্রোহীদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ বাঘা বাঘা অনেক নেতা হেরেছিলেন। ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয় নির্বাচনের নিস্তরঙ্গ পুকুরে কিছুটা আলোচনার ঢেউ তুলতে পেরেছিল। যদিও জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতাই। তবে নিজেরা নিজেরা এই খেলায় বেশ মজাই পেয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে করার বিধান স্থগিত করে সবার জন্য নির্বাচনের মাঠ উন্মুক্ত করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে দুটি সিটি করপোরেশন ও বেশ কয়েকটি পৌরসভায় নয়া স্টাইলে নির্বাচন হয়েছে। এবার সামনে উপজেলা নির্বাচনের পালা। জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষমতা কাঠামোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উপজেলা নির্বাচন। চারধাপে দেশের ৪৮১টি উপজেলায় নির্বাচন হবে। আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে। আজ ১৫ এপ্রিল প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিন।
তবে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রধান দুই দলই সঙ্কটে আছে। বিএনপি অনেকদিন ধরেই বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার অবস্থানে অনড়। সফল না হলেও তারা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে আছে। কিন্তু বারবার নির্বাচন বর্জনের কৌশল বিএনপিকে অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আন্দোলনের কৌশল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার চাপ আছে তৃণমূলে। কিন্তু বিএনপি আন্দোলনের যে পর্যায়ে আছে, তাতে তাদের পক্ষে ঘোষণা দিয়ে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়া নৈতিকভাবে প্রায় অসম্ভব। বিএনপি এখনও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দ্বিধায় আছে। আগ্রহী প্রার্থীরা দলীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। তবে আমার ধারণা বিএনপি শেষ পর্যন্ত পুরো বিষয়টি উপেক্ষার কৌশল নেবে। দেখেও না দেখার ভাণ করবে। যেহেতু দলীয় প্রতীকের বিষয় নেই, তাই স্থানীয় নেতারা অংশ নিলেও সেটি দলীয় অংশগ্রহণ হিসেবে বিবেচিত হবে না। তাই তাদের আন্দোলনের নৈতিক শক্তিও এতে ব্যাহত হবে না। আর যদি কেউ জিতে আসেন, তাতে তো বিএনপির লাভই হবে, ক্ষতি নয়।
তবে উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্কট বিএনপির চেয়ে অনেক বেশি এবং বহুমুখী। এমনিতেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলীয় কোন্দল শিরায় শিরায় ছড়িয়ে আছে। উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে সে দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়েছে। প্রতিটি উপজেলাতেই আওয়ামী লীগের ৫/৭ জন সম্ভাব্য প্রার্থী আছে। যেহেতু দলীয় প্রতীক নেই, তাই সবাই নির্বাচন করতে চাইবেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে মন্ত্রী-এমপিদের সাথে তৃণমূলের দূরত্ব আরো বেড়েছে। মন্ত্রী-এমপিরা নিজেদের ঘরের বা ঘরানার লোকদের পাস করাতে মরিয়া, যেখানে আপত্তি ত্যাগী নেতাদের। আওয়ামী লীগ তৃণমূলের নেতাদের ডেকে এসে দুরত্ব কমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। নিজেদের স্বার্থ কেউ ছাড় দেবে বলে মনে হয় না। বরং প্রতীক না থাকার সুবিধায় অনেকেই প্রার্থী হবেন। আওয়ামী লীগ অবশ্য এটাই চায়। বিএনপি না এলেও যেন প্রার্থীর কমতি না থাকে। তবে ভয়টা হলো, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী না হলেই হয়। অতীতে আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের নিজেদের দ্বন্দ্ব বরং অনেক বেশি প্রাণঘাতী হয়।
তবে সাধারণ মানুষের চাওয়া অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। যাতে সবাই নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। তবে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আমরা যেভাবে ধ্বংস করেছি, তাতে বাংলাদেশে এই চাওয়া কবে পূরণ হবে বা আদৌ কোনোদিন হবে কিনা; কে জানে?
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জিকেএস