ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মুজিবনগর দিবস : মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৭:২১ এএম, ১৭ এপ্রিল ২০১৬

আজ ১৭ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে সূচিত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকারের শপথ গ্রহণের দিন। কোনো স্বাভাবিক সময়ে সরকার গঠনের পর পরই সরকার প্রধান এবং মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করে থাকে। তারপরই দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ের কাজ শুরু করেন মন্ত্রীগণ। কিন্তু ১৯৭১ সালে পরিস্থিতি মোটেও সেই সরকারের অনুকূলে ছিল না। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিত হামলা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তান বাহিনী দেশব্যাপী তাদের বাঙালি নিধন অভিযান শুরু করলে ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে রায় পাওয়া দল হিসেবে সরকার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১০ এপ্রিল গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের সরকার। সেই সরকারই ১৭ এপ্রিল শপথ নেয়। এসব ঘটনা তিলে তিলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নির্মাণ করেছে, সফল করেছে, বিজয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে গেছে।

১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ১০ এপ্রিল গঠিত সরকার দলবল নিয়ে আসবে, যুদ্ধাবস্থার সাজে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক পরিবেষ্টিত হয়ে শপথ নেবে, গগণবিদারি স্লোগান, সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বক্তৃতা করবেন- এমন কথা ঐদিন সকালেও কেউ ভাবতে পারেনি। কোনো পূর্ব সংবাদও কেউ জানতো না। জানা থাকলে পাকিস্তান সরকার কী করতো তা-ও ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমাদের মহান  মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যে সরকার ১০ এপ্রিল যাত্রা শুরু করেছিল তারা বাংলাদেশ ভূখন্ডেই তাদের শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে একদিকে আপামর জনগণের মনে অসীম সাহসের সঞ্চার করেছিল, অন্যদিকে গোটা বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক যাত্রাকে প্রদর্শন করেছে, নিজেদের মেধা, যোগ্যতা এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নে আপোসহীন লড়াই ও যুদ্ধ পরিচালনার অদম্য স্পৃহার বিপ্লবাত্মক দৃশ্য উপস্থাপন করেছে।

সরকার শুরুতেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, শপথ গ্রহণের পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠান শেষে বীরদর্পে স্থান ত্যাগ করেছে, যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শপথ স্থানটিকে মুজিবনগর নামকরণ করে গেলেন- যা মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পরিচয় এবং চেতনার উৎসকে জানান দিয়ে গেছে। বিপ্লবাত্মক কোনো যুদ্ধকালে নেতৃত্ব এ ধরনের অবাক বিস্ময় সৃষ্টির কাজ করেই অগ্রসর হন-  যা দেখে জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়, জনসমর্থন স্পষ্ট হয়, দেশি-বিদেশি বিরোধী অপশক্তি পর্যুদস্ত হয়। ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় আকস্মিকভাবে রণসজ্জায় সজ্জিত সরকারের শপথ গ্রহণ নেওয়া মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ইতিহাসে অন্যতম এক মহিমান্বিত রোমাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা এবং অধ্যায়। কেবল এমন বুদ্ধিদীপ্ত এবং সাহসী নেতৃত্বই রণাঙ্গণকে জয় করতে পারে। একই সঙ্গে মুজিবনগর সরকার পরিচয় নিয়ে গোটো মুক্তিযুদ্ধকে দেশে-বিদেশে নেতৃত্ব দেওয়া দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করেছে।

১০ এপ্রিল জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ বিজয়ী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতাকে সফল করতে বঙ্গবন্ধুকেই সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপতি করে তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ভার দেওয়ার বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, তারা একটি জাতির ইতিহাস নির্মাণে কতোটা যোগ্য ছিলেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীসহ ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সরকার গঠন করা হয়। সেই সময়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অত্যন্ত প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে সরকার গঠন করেন। সরকার গঠন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা ও ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠন এবং ১৭ এপ্রিল তারিখ বাংলাদেশের ভূখন্ডের অভ্যন্তরে শপথ অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি ঘটিয়েছেন।

আমাদের জনপ্রতিনিধিগণ সরকার তাদের প্রতিটি পদক্ষেপই সেই সময়ের অপরিহার্য এবং মুক্তিযুদ্ধকে একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার অংশ হিসেবে পরিচিতি প্রদানে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গভীরভাবে পাঠ করলে যে কোনো মানুষের কাছেই স্পষ্ট হতে বাধ্য। একই সঙ্গে এসব পদক্ষেপ দারুণ বিস্ময়কর, সাহসী এবং কিংবদন্তিতূল্য ঘটনা বলেও মনে হবে। এর মধ্যে দিয়ে যে বিষয়টি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে তা হলো বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ যাদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল তারা প্রত্যেকে কতোটা প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, তাদের দেশপ্রেম, সাহস, সততা, দূরদর্শিতা, আদর্শিক দৃঢ়তা, বঙ্গবন্ধুর প্রতি কতোটা অবিচল আস্থাসহ নানা গুণাবলির সমন্বয়ে মহৎ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চারপাশে এমন সব মেধাবী এবং যোগ্য নেতৃত্বের সম্মিলন ঘটেছিল যারা প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সক্ষম ছিলেন।

যে বিষয়টি একালের প্রতিটি মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে তা হচ্ছে কতো কঠিন ছিল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, সেই কঠিন, দুরূহ চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছি এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হতে পেরেছি। আমাদের জাতীয় জীবনে তখন যে স্বাধীনতার আকাক্ষা দোলা দিয়েছিল তা কতো তীব্র ছিল, সেই আকাক্ষা বাস্তবায়নের জন্যে কেন এতো মানুষ এতো সহজে দেশের জন্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছিল তা চিন্তা করতেও শেখায়- এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো, দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার একটি প্রাণপণ চেষ্টা বিএনপি-জামায়াতসহ একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে চলে এসেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এইসব কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার থেকে প্রচারিত জিয়াউর রহমানের ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে আখ্যায়িত করে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের এতোসব বড় বড় মহিমান্বিত অধ্যায়কে আড়াল করার যে চেষ্টা করেছে তার ফলে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছে। সে কারণেই দেখা যায়, এতো মহৎ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক ঘটনাই আমাদের সমাজের অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে খণ্ডিতভাবে জানার মধ্যে রয়ে গেছে, অনেকেই ভালো করে মুক্তিযুদ্ধের এসব অবিচ্ছেদ্য অংশের গুরুত্ব আলাদা বা সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন না। এটি আমাদের জন্যে বেশ গ্লানিকর বটে। আমরা আশা করবো, বর্তমান এবং আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ইতিহাসই এর মূল চেতনায় উপলব্ধি করার চেষ্টা করবে। এর জন্যে তাদেরকে তথ্য উপাত্তসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পড়তে হবে, জানতে হবে, তবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার আয়োজন ফলপ্রসূ হতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন