ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মাহে রমজান

জাকাত প্রদানে সম্পদ পবিত্র হয়

মাহমুদ আহমদ | প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ০২ এপ্রিল ২০২৪

আজ নাজাতের দশকের দ্বিতীয় দিন। ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। সুষম সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এটি আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি হল জাকাত।

পবিত্র কুরআন করিমে বহু জায়গায় জাকাতের সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের শিক্ষা হলো, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ সকল মানুষের জন্য, কোনো ব্যক্তি বিশেষের একার জন্য নয়। যেভাবে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি পৃথিবীতে যাই আছে সবই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২৯)।

মানুষ কষ্ট করে সম্পদ অর্জন করার পরও সেই সম্পদে শুধু তারই নয় বরং অন্যদেরও কিছু অধিকার আছে। এ অধিকার পূর্ণ করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অভাবী লোকদের মাঝে তা বিতরণের জন্য জাকাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া জাকাতের নির্দেশ এ জন্যও দেয়া হয়েছে যে, অনেক সময় কোনো কোনো লোক গরীবদের প্রতি নানা কারণে দৃষ্টি দিতে পারে না বা দেয় না। সেজন্য জাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের বাঁচার ন্যূনতম অধিকারকে বিধিবদ্ধভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং বায়তুল মালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইসলামের শিক্ষা হল সবাই বায়তুল মালে জাকাতের অর্থ জমা দিবেন এবং সেখান থেকে গরীব-অসহায়দের মাঝে বিতরণ করা হবে। কে দান করেছে বা কোথা থেকে এসেছে তা কারো জানা থাকবে না।

মহানবির (সা.) সময় এমনই বায়তুল মালের ব্যবস্থা ছিল, যেখান থেকে সাহায্যপ্রার্থীদের সাহায্য এবং অভাব দূর করার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু আজ ইসলামে একক নেতৃত্ব না থাকায় সেই বায়তুল মালের ব্যবস্থাপনাও হারিয়ে যায়। যেহেতু ইসলামি নিয়ম কানুনকে মানুষ আজ ভুলে বসেছে তাই এত সব বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে আর জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে কাফনের কাপড় লাভ করার সংবাদও পাওয়া যায়।

জাকাত একটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করে। এর ফলে গ্রহীতার আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব ক্ষুন্ন হয় না। জাকাতদাতার সরাসরি বিতরণে এটা সম্ভব নয়। কেননা মহানবি (সা.) বলেছেন, ওপরের হাত নিচের হাত থেকে শ্রেষ্ঠ। তাই জাকাতদাতা যদি নিজে বিতরণ করেন তাহলে দানের হাত ওপরে থাকে আর গ্রহীতার হাত নিচে। ফলে দাতার সামনে গ্রহীতা স্বাভাবিকভাবে সব সময় মাথা নিচু করে চলবে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে আবার পাওয়ার আশায়। এতে তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু একটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জাকাত বন্টনে এ ত্রুটি ঘটে না। কারণ গ্রহীতা এটা আল্লাহ তাআলার ব্যবস্থায় অধিকার লাভ হিসেবে লাভ করে।

সবাই যদি সঠিকভাবে জাকাত প্রদান করে তাহলে সমাজ ও দেশে সামান্য কাপড়ের জন্য প্রাণ হারাতে হতো না। আমরা সঠিকভাবে জাকাত প্রদান করি না বলেই এমন হাহাকার। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ধনী ব্যক্তি নিজের ধন-সম্পদ হতে জাকাত আদায় করে না, তার ধন-সম্পদকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং উত্তপ্ত শলাকা দ্বারা তাদের কপালে এবং মুখ মন্ডলে দাগ দেয়া হবে এবং এ শাস্তির মেয়াদ পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান হবে’ (বুখারি)।

মহানবি (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ধনসম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে এর জাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন তার সেই ধনসম্পদ এক ভয়ংকর সাপের আকারে দৃষ্ট হবে, উক্ত সাপ কিয়ামতের দিন তার গলায় জড়িয়ে থাকবে এবং চোয়াল দংশন করতে করতে বলবে, আমি তোমার সেই ধনসম্পদ যার জাকাত তুমি দাওনি’ (বুখারি ও মেশকাত)।

জাকাত গরীবদের ওপর কোনো অনুগ্রহ নয় বরং এটি দানকারীর নিজের মঙ্গলের জন্য এবং তার মাল পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করার এক ব্যবস্থা। এজন্য পবিত্র কুরআনে বার বার বলা হয়েছে ‘নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত দাও’। এছাড়া জাকাত প্রদান করলে ধন-সম্পদে কমতি হয় না। কোনো কোনো দুর্বল ঈমানদার ব্যক্তি মনে করেন, জাকাত দিলে ধনসম্পদ কমে যাবে। কিন্তু আল্লাহই সব উপজীবিকা এবং রিযিকের মালিক।

আল্লাহ তাআলা কুরআন করিমে বলছেন, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং সে তোমাদেরকে অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ নিজ পক্ষ হতে তোমাদেরকে ক্ষমা এবং আশিসের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। বস্তুত আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী এবং সর্বজ্ঞ’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২৬৮)।

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা শয়তানি প্ররোচনা হতে মানুষকে সতর্ক করেছেন। শয়তানি প্ররোচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ যখন আল্লাহর পথে জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে দারিদ্রের ভয় করে, তখন দারিদ্র এবং অশ্লীলতা প্রবলভাবে সমাজ দেহকে জর্জরিত করে ফেলে। তখন ধনী-দরিদ্র সবারই পক্ষে জীবন ধারণ করা অসহনীয় হয়ে পড়ে। দারিদ্র এবং সামাজিক কদাচার সকলকেই প্রভাবিত করে। এ অবস্থা সৃষ্টি হবার পূর্বেই সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য জাকাত প্রদান করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

যাকাতের নিসাব পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও যারা তা আদায়ে ব্রিত হয় না, তাদের বিষয়ে হাদিসে এসেছে, ‘যখন কোন জনগোষ্ঠী জাকাত আদায় হতে বিরত থাকবে, তাদেরকে চরম দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন করা হবে।’ (তাবরানি, বায়হাকি) তাই আমাদেরকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

জাকাতের অর্থ হলো সম্পদকে পবিত্র করা। নামাজের মাধ্যমে যেমন আত্মা পবিত্র হয় তেমনি জাকাতের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়। জাকাত এমন একটি দান যা প্রভাবশালীদের কাছে থেকে নিয়ে গরীব-অভাবীদের দেয়া হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তোমরা জাকাত হিসেবে যা দাও সে ক্ষেত্রে এরাই সেইসব লোক, যারা (জাকাতের মাধ্যমে নিজেদের ধন-সম্পদ) বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে’ (সুরা রূম: আয়াত ৩৯)।

জাকাতের উদ্দেশ্য শুধু গরীব দু:খিদের প্রতি বিশেষ ত্রাণের ব্যবস্থা করা অথবা আর্থিক দিক দিয়ে যারা পিছনে পড়ে আছে তাদের উন্নয়ন করাই নয় বরং এর দ্বারা অর্থ সম্পদ এবং পণ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখার অভ্যাসও দূর হয়। এখন জাকাত প্রদান একটা ফ্যাসনে রূপ নিয়েছে। সারা বছর তার পশের বাড়ীর মানুষটি যে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে তার খবর না রেখে রমজানে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জাকাত প্রদান করতে দেখা যায়। কোনো কোনো ব্যক্তি নিজের প্রচার-প্রচারণার জন্য মাইকিং করেন, পোস্টার টাঙিয়েও জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের আয়োজন করেন যা ইসলামি বিধান পরিপন্থি কাজ।

যেহেতু জাকাত প্রদানের নির্দেশ আল্লাহ তায়ালার, তাই আসুন আল্লাহর নির্দেশে জাকাত আদায় করে, সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করি, গরীবদের অধিকার আদায় করে, তাদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তুলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকারী হই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন