ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলা নববর্ষ আমাদের সামাজিক উৎসব

প্রকাশিত: ০২:২১ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০১৬

বাংলা নববর্ষ অবশেষে সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাঙালির সামাজিক উৎসব হিসেবে বর্তমানে ব্যাপকভাবে উদযাপিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। একসময় বাংলা নববর্ষ ছিল মূলত এই কৃষিসমাজের গ্রামীণ আয়োজন। কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, কৃষিপণ্য, আর ছেলে ভুলানো খেলা ও খাওয়ার সামগ্রী নিয়ে গ্রামীণ মেলা হত। বলা যায়, এ ছিল কৃষি সমাজের উৎসব। পাঁচের দশক থেকে শুরু হল ছোট ছোট শহুরে আয়োজন, তা একটা নাগরিক সাংস্কৃতিক আয়োজনের রূপ পেল ছায়ানটের উদ্যোগের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে এ উৎসব শহর ও গ্রামে ছড়িয়েছে। এককালের গ্রামীণ আর বর্তমান কালের নাগরিক মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক এ উৎসব বর্তমানে সারা দেশে অরাজনৈতিক সামাজিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। বাঙালি-অবাঙালি সকলেই এতে অংশ নিচ্ছেন।

আমাদের দেশে সকল বাঙালি যৌথভাবে পালনের মত কোন সামাজিক উৎসব ছিল না। দুই ঈদ কিংবা দুর্গাপূজা হল ধর্মীয় উৎসব- মুসলমান ও হিন্দু সীমিতভাবে এ সময়ে পরস্পরের সাথে লৌকিকতা বা সৌহার্দ্য বিনিময় করলেও তা কখনও ধর্মীয় গণ্ডি ভাঙতে পারে নি, পারার কথাও নয়। আবার একুশে ফেব্রুয়ারি ঠিক আনন্দ উৎসবের দিন নয়- এ দিনটি জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অসাম্প্রদায়িক বাঙালির করণীয় নির্ধারণের দিন। জাতীয় প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব পালন ও দায়বদ্ধতার মত সিরিয়াস বিষয় এখানে বিবেচ্য। তাই হয়ত উৎসবের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক এখানে উপেক্ষিত- নতুন পোশাক ও উন্নত খাওয়া দাওয়া। তাছাড়া প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা এবং সামাজিক পরিমণ্ডল ছাড়াও পারিবারিক পরিমণ্ডলে উদযাপনের বিশেষ সুযোগ নেই বৈশাখের এই দিনটির। এটা সবসময়ই গণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু বক্তব্যসহ জাতীয় প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ ঘটিয়েই পালন করা সম্ভব।

এখন পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠানের রীতিমত জোয়ার চলে, পথে ও প্রাঙ্গণে ঢল নামে নারী-পুরুষ-শিশু আবাল বৃদ্ধ বণিতার। ছায়ানট যখন আইয়ুবের সামরিক শাসনের রক্ষচক্ষু উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে নববর্ষ উদযাপন শুরু করেছে গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায় তখন সারা দেশে এটিই ছিল বাংলা বর্ষবরণের উল্লেখযোগ্য প্রভাতী অনুষ্ঠান। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে ছোটখাট অনুষ্ঠান কিছু হত। কিন্তু নাগরিক মানুষ নববর্ষ উদযাপন ও উপভোগ করেছে, অংশ নিয়েছে এবং অনুপ্রাণিত হয়েছে  ছায়ানটের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই। দেশের অনেক জায়গায় এটিকে অনুসরণ করে ধীরে ধীরে নববর্ষের প্রভাতী সঙ্গীতানুষ্ঠান চালু হয়। এভাবে গ্রামীণ উৎসব ও নাগরিক আয়োজন এক বিন্দুতে এসে মিলে যাচ্ছে। এখন বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের জন্যে দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। কোথাও কোথাও সপ্তাহব্যাপী দেশীয় পণ্যের মেলাও চালু হচ্ছে। সরকারের আগ্রহে ও নির্দেশে বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে, শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজনে পিছিয়ে থাকছে না। শহরের ছাপ পড়ছে গ্রামের অনুষ্ঠানেও।
উৎসবের প্রসঙ্গে এবার আরেকটি দিকে আলোচনা করতে চাই।

প্রশ্নটা হল, আমরা তো বলছি উৎসব, বলছি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন উৎসব। উৎসব কেবল ভোগে বিলাসে হৈচৈয়ের মধ্যেই কাটিয়ে দিচ্ছি না তো? সারাটা দিন মাইকে মাইকে গীতকলরব, বাদ্যগীতসহ শোভাযাত্রা, পথে পথে ভিড়-জনসমুদ্র, দিন শেষে ক্লান্তিই কি থাকল অবশেষ? বছরের এই শুরুর দিনটি নানা আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হোক। কিন্তু প্রভাতী অনুষ্ঠানটি হোক সুপরিকল্পিতভাবে। সারা বছরের জন্যে মন ও মস্তিষ্ক কিছু কিছু রসদ পাক সে অনুষ্ঠানে। উৎসব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি, তাঁর লেখা থেকে এ বিষয়ে জানতে পারি। তিনি লিখেছেন-‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মানুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেইদিন।’

এই প্রতিপাদ্য আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন তিনি এভাবে- ‘যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না- যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখ-দুঃখের দ্বারা ক্ষুব্ধ করি, সেদিন না- যেদিন প্রাকৃতিক নিয়ম পরম্পরার হস্তে আপনাদিগকে ক্রীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো- সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি না- সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট- সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না- সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না- সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সংগীত শোনা যায় না।’

আরও স্পষ্টভাবে কথাটা এরকম-  ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ এদিন আমরা ব্যক্তিবিশেষ নই, মানুষ হিসেবেই নিজেকে জেনে ও সেভাবে প্রকাশ করে ধন্য হই।

রবীন্দ্রনাথের এই ভাবাদর্শিক পথনির্দেশের সূত্রে আমরা বলতে পারি নববর্ষের উৎসবের ভাবাদর্শের মধ্যে থাকবে দেশ ও জাতির জন্যে, বিশ্ব ও মানবতার জন্যে কল্যাণ কামনা ও আত্মনিবেদনের অঙ্গীকার; মহৎ আদর্শ ও উচ্চভাবে ত্যাগের উদ্দীপনায় শ্রীময় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার কাজে ব্রতী হওয়ার অঙ্গীকার। ফলে অনুষ্ঠানের একটা পরিকল্পনা তৈরি করতে পারি আমরা। প্রভাতী সমাবেশ হবে এদিন, রমনার বটমূলে যেমন ছায়ানটের আয়োজনে হয়ে থাকে- ছোটবড় যত বেশি সম্ভব  সারাদেশে সর্বত্র। তাতে কোন সর্বমান্য শ্রদ্ধেয় বয়স্কজন- নারী বা পুরুষ, হিন্দু বা মুসলমান বা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান বা ধর্ম বিষয়ে মুক্ত ব্যক্তি- সমাগতদের উদ্দেশ্যে মূল ভাবাদর্শের আলোকে আশীর্বচন উচ্চারণ করবেন।

এতে সমস্যা দেখা দিলে উদ্যোক্তাদের সর্বসম্মতিতে লিখিতভাবে নববর্ষের ঘোষণা পাঠ হতে পারে। তারপর নৃত্য ও বাদ্যসহ সঙ্গীত ও আবৃত্তির অনুষ্ঠান। এরপর রাখিবন্ধন হলে কেমন হয়? বঙ্গভঙ্গের আদলে শুধু হিন্দু-মুসলিমে নয়, নারী-পুরুষে, ধনী-দরিদ্রে, ছোট-বড়তে, হিন্দু-মুসলিমে, শহুরে-গ্রাম্যে এবং যে কোন রকম বিন্যাসে (অর্থাৎ নারীতে-নারীতে, মুসলিমে-মুসলিমে, ধনীতে-ধনীতে ইত্যাদি) রাখিবন্ধন হবে। ইতিহাসের এখনকার দাবি ও চাহিদা এরকমই। শোভাযাত্রাতে তারপর যোগ দেওয়া যায়, কিংবা শোভাযাত্রা থেকে দিনের সকল কার্যক্রম শুরুও হতে পারে। তারপরেই শেষ? না, নববর্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় ও জ্ঞাপনের রেওয়াজটা অনুষ্ঠানস্থল থেকে বাড়ি পর্যন্ত আসুক। ছোটরা বড়দের ফুল দেবে, বড়রা ছোটদের বই দেবে, বয়স্ক সমবয়সীরা ফুল/বই বিনিময় করবে- মোট কথা উপহার বিনিময় ও প্রীতি সম্ভাষণ চলবে। আর বাড়ি পর্যন্ত আসা-যাওয়ার প্রথা শুরু হলে মিষ্টিমুখ, বিশেষ খাবারের আয়োজন স্বভাবতই চলে আসবে।

তখন অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব সত্যিকারের রূপ পাবে, সংসারের মাটিতে শিকড়বদ্ধ হবে এবং জীবনকে শিল্প ও সংস্কৃতির রসদ জোগাবে। উৎসবের আবহে জীবন আনন্দময় হবে, মুক্তি ও বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।

পহেলা বৈশাখে ধীরে ধীরে সেই লক্ষণ দেখতে পেয়ে মন কিছুটা আশ্বস্ত হয়, আবার খানিকটা এগিয়ে বার বার পিছিয়ে পড়ার যে ইতিহাস আছে আমাদের তা মনে পড়লে শঙ্কিত না হয়ে পারি না।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, সমাজচিন্তাবিদ

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন